আজিমপুরের দুর্দান্ত যোদ্ধারা, পঞ্চম পর্ব

 

সকালের নাস্তার পর ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ডাক পড়ল। যেয়ে দেখি তাঁবুতে ক্যাপ্টেন একা, সামনে এক মগ চা, বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, ডান হাতে একটি পেনসিল, টেবিলে একটি খাতা। ক্যাপ্টেন খুব মনোযোগ সহকারে খাতায় কী যেন আঁকছেন। আমাকে দেখে ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন এবং সিগারেটের প্যাকেট দেখিয়ে দিলেন। আমি প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালাম। ক্যাপ্টেন তার ব্যাটম্যান শহিদকে হাঁক দিলেন। শহিদ এলে আমাকে চা দিতে বললেন। শহিদ একটি ফ্লাক্স থেকে মগে চা ঢেলে আমাকে দিল। আমি সিগারেট খেতে খেতে চা-তে চুমুক দিতে থাকলাম। ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “দেখ তো, কিছু বাদ গিয়েছে কি না?”

আমি খাতাটা নিয়ে দেখলাম ক্যাপ্টেন রেললাইন ও আশেপাশের এলাকার একটি ম্যাপ এঁকেছেন। কুটিরগুলো, সামনের ধান ক্ষেত, ডানদিকের কালভার্ট, রেললাইন, ইত্যাদির একটি ম্যাপ। কিন্তু মনে হলো কিছু গাছপালা ম্যাপে নেই। আমি ক্যাপ্টেনকে সে কথা বলতে তিনি ম্যাপে সেগুলো যোগ করলেন।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই আমি আমাদের পরবর্তী অপারেশনের কথা ভাবছিলাম, যদিও নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা এখনো দানা বাঁধেনি। আমাদের বিস্ফোরকের যে ট্রেনিং হয়েছে সেটা ব্যবহার করে একটি আবছা মত ধারণা জন্মেছে।

আমি ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাস করলাম, “ট্রেনের ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য কত? একেকটি বগির দৈর্ঘ্য কত? এসব তথ্য কি আমরা জানি?

 না, ঠিক জানি না তবে জানা যাবে। কিন্তু তুমি দৈর্ঘ্য দিয়ে কী করবে?” ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন।

আমি কি আপনার খাতা ও পেনসিল নিতে পারি?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমি টেবিল থেকে খাতা ও পেনসিল নিলাম। খাতায় ইঞ্জিন সহ চারটি বগি আঁকলাম। তারপরে ক্যাপ্টেনকে ছবিটি দেখিয়ে বললাম, “আমরা রেললাইনের নীচে পাঁচটি বিস্ফোরক চার্জ লাগাবো। প্রথমটি রেল ইঞ্জিনের জন্য, শুধু এটার সাথে বৈদ্যুতিক ডেটনেটর থাকবে। অন্য বিস্ফোরক চার্জগুলো এমন দূরত্বে রেললাইনের নীচে লাগান হবে যেন ঠিক বগিগুলোর নীচে থাকে। এই পাঁচটি বিস্ফোরক একটির সাথে আরেকটি এক্সপ্লোসিভ-কর্ড (explosive cord) দিয়ে সংযুক্ত করা থাকবে। ফলে ইঞ্জিনের নিচের প্রথম চার্জটি বিস্ফোরকের সাথে চারটি বগির নিচের বিস্ফোরকগুলো একইসাথে বিস্ফোরিত হবে। তাহলে শুধু ইঞ্জিন না, বগি শুদ্ধ সম্পূর্ণ রেলগাড়িকে গুড়িয়ে দিতে পারব,” কথা শেষ করে আমি ক্যাপ্টেনের দিকে উত্তরের আশায় প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

ক্যাপ্টেন আমার কথা শুনার পর গভীর চিন্তায় আমার আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, “কিন্তু আমাদের মধ্যে ভাল ভাবে বিস্ফোরক লাগাতে জানে একমাত্র মাসুম, কিন্তু এখানে তো মোট পাঁচটি চার্জ লাগাতে হবে এবং অনেক সময় লাগবে। এত সময় আমরা পাব কোথায়?”

ক্যাপ্টেন আপত্তির মাধ্যমে আমার প্রস্তাব প্রায় বাতিল করার অবস্থা। সাথে সাথে আমি উত্তর দিলাম, “মাসুমকে আমাদের কয়েকজনকে বিস্ফোরকের ট্রেনিং দিতে বলেন। রেললাইনের নীচে বিস্ফোরক লাগান কোনো কঠিন কাজ না, আমরা ঠিকই পারব,“ আমার আত্মবিশ্বাসী দৃঢ় কণ্ঠ। ক্যাপ্টেন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “ঠিক আছে, তোমার প্রস্তাব আরেকটু ভেবে দেখি, আমি তোমাকে পরে জানাব, আর কিছু?“

রেললাইনে অনেক পাথর, বিস্ফোরণের ফলে এই পাথর শিলাবৃষ্টির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সে জন্য আমাদেরকে ফক্সহোল তৈরি করে অবস্থান নিতে হবে, তাছাড়া মাথায় পাথর পড়ে মাথা যেন না ফাটে সেজন্য হয় হেলমেট অথবা অন্য কোনো উপায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে,“ আমি যোগ করলাম।

ঠিক আছে, আমি কালকে তোমাকে জানাব। তাছাড়া আমি মাসুমকে বলে দিচ্ছি কালকে থেকে তোমাদের বিস্ফোরকের ট্রেনিং শুরু করতে,” ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হলে আমি তাঁবুতে ফিরে গেলাম। ঘড়িতে তখন বেলা দশটা।

তাঁবুতে পৌঁছে সবাইকে আজকের মধ্যে কে কোন তাঁবুতে থাকবে সেটা নির্ধারণ করে কাজ সম্পূর্ণ করতে নির্দেশ দিলাম।

আমাদের চারটি সেকশন। প্রত্যেকটি সেকশনে দশ জন করে। সেকশন কমান্ডারদের নাম; সেলিম, সারোয়ার, টুটুল, ও মোসলেম।

দুপুরের খাবার আগেই লোকজনের স্থানান্তর শেষ হয়ে গেল। একটি তাঁবুতে ২০-জন ও দুইটি তাঁবুতে দশ জন করে। বড় তাঁবুতে টুটুল ও মোসলেমের সেকশন, অন্য তাঁবু দুটির একটিতে সেলিম, অন্যটিতে সারোয়ারের সেকশন। আমি সারোয়ারের তাঁবুতে স্থানান্তরিত হলাম।

আমাদের তাঁবুতে সারোয়ার ছাড়া অন্যান্যরা হলো পলাশীর কবীর, কবীরের সহকারী সিদ্দিক বাজারের ইদ্রিস, আমাদের গুপ্তচর লালবাগের সবুজ, ভৈরবের দুই জন; গাড়ির ম্যাকানিক ইব্রাহিম ও জেলে ইসহাক; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র আমানত, ও সরাইলের তিন জন; ট্রাক চালক আলী, মাঝি বেলাল, ও ট্রাকটার চালক হাকিম। এই সেকশনে শুধু হাকিমের ৩০৩ রাইফেল। বাকীদের স্টারলিং অথবা SLR রাইফেল।

দুপুরের খাবারের পর তাঁবুতে এসে আমার বিছানায় বসলাম। আমাকে অন্যদের সাথে বসতে দেখে কয়েকজন বেশ অস্বস্তিতে পড়ল বলে মনে হলো।

আমি প্রথমে ঘোষণা করলাম, “আমাকে কেউ স্যার বলবা না। আমরা সবাই সবার ভাই। আমরা সবাই সমান। আমাকে দরকার হলে সোহেল ভাই ডাকবে। আমরা সবাই দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছি। কাজেই আমার প্লাটুনের কেউ কারো স্যার না। সবাই মনে রাখবে।

আমি লক্ষ্য করলাম দুই তিন জন একটি বিড়ি ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। মানে তাদের বিড়ি কেনার সামর্থ্য নেই।  অনেকের গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, অনেকের জামা কাপড় খুবই নোংরাতার মানে গোছল করার ও কাপড় কাচার সাবান নেই। এভাবে নোংরা হয়ে থাকলে সবার অসুখ হবে।  ক্যাপ্টেন রানার সাথে আলোচনা করে এসব সমস্যার একটা স্থায়ী বিহিত করতে হবে।

তাঁবুতে আমরা দুই সারিতে ঘুমাই। আমার সারিতে প্রথমে সারোয়ার, তারপরে পর্যায়ক্রমে আমি, কবীর, ইদ্রিস, ও সবুজ। অন্যদিকের সারিতে (সারোয়ারের বিপরীতে) পর্যায়ক্রমে ইব্রাহিম,  ইসহাক; আমানত, আলী, বেলাল, ও হাকিম।

আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি, সুবেদার-মেজর বশীর আমাদের যাদের লুঙ্গি ছিল না ইতোমধ্যে তাদের সবাই কে একটি লুঙ্গি দিয়ে গেছেন।

বিকেল চারটার সময় আমি কবীর ও রহিমকে সাথে নিয়ে বাজারে গেলাম। যাবার আগে রহিমকে সাথে ৩০০-৪০০ টাকা নিতে বলেছিলাম। বাজারে পৌঁছে মুদির দোকান থেকে দশটা বল সাবান, দশটা গোছল করার সাবান, আমার জন্য একটি খাতা ও দুটি পেনসিল, ৫০-প্যাকেট বিড়ি, ও দাঁত মাজার জন্য প্রায় ২০-টা নিমের ডাল (আমি নিজেও এখন নিমের ডাল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করি)। মুদির দোকানদারকে বল সাবানগুলো চার ভাগ করে দিতে বললে দোকানদার দোকানের একপ্রান্তে দেয়ালের সাথে ঝুলানো এক টুকরা গুনা তার দিয়ে নিমেষেই বল সাবানগুলো কেটে দিল।

কেনাকাটা শেষ হলে আমারা তিনজন সেই আগের চায়ের দোকানে রসগোল্লা ও নিমকি সহকারে গরম গরম চা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। রহিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ও কবীর আমাদের তাঁবুতে ফিরে এলাম।

তাঁবুতে ঢুকেই সবাইকে তাঁবুতে ডাকলাম, সবাই এলে প্রত্যেককে এক টুকরা কাপড় কাচার সাবান, ও একটা গোছলের সাবান দিলাম। কালকে সকালে নাস্তার পরে সবাই নিজেদের বিছানাপত্র তাঁবুর সামনে রোদে শুকাতে দিবে। তারপর তোমাদের সকলের নোংরা কাপড় ধোয়ার পর ভাল করে সাবান দিয়ে গোছল করবে। তারপর থেকে প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোছল করতে হবে। মনে থাকবে?” কেউ মাথা নেড়ে আর কেউ জী বলে সম্মতি জানাল।

তারপরে আমি বিড়ির বান্ডিলগুলো বের করে বললাম, “তোমরা যারা বিড়ি খাও তাদের জন্য এখানে বিড়ি আছে। তোমাদের দরকার মতো নিয়ে নিও।

বাকী সাবানগুলো সেলিমকে দিলাম।

দেখতে দেখতে স্ট্যান্ড-টুর সময় হয়ে এলে আমরা সবাই তাঁবু থেকে বের হলাম।

রাতের খাবার পর আবার ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গেলাম। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে তাকে আমাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সমস্যা জানালাম। কেন, সাবান তো সবাই পায়, তোমরা নতুন বলে হয়ত পাওনি। আমি বশীর সাহেবকে বলে দিব।ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হলে আমি আমাদের সিগারেটের সমস্যা জানালাম। ক্যাপ্টেন প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। ক্যাপ্টেন রেললাইন সম্পর্কে কিছু না বলাতে আমিও কিছু বললাম না।

তাঁবুতে ফিরে আসতে আসতে একটু খটকা লাগল, সুবেদার মেজর বশীর কি আমাদের আগমনে বিরক্ত? আমাদের প্রতি তার এই বৈমাত্রেয় আচরণের কারণ কী? আমরা আসার পরে ক্যাপ্টেনের আমাদেরকে এত সময় ও গুরুত্ব দেয়া কি তার পছন্দ হচ্ছে না। আমরা তো তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েছি। অবশ্য আমাদের ১৪-জনের দলের কেউ ক্যাপ্টেন রানাকেও স্যার সম্বোধন করে না। সুবেদার মেজরকে সম্বোধন করার প্রয়োজন হলে বশীর সাহেবসম্বোধন করি। EPR-এর সদস্যরা অবশ্য তাকে স্যারসম্বোধন করে। এটা কী একটি কারণ হতে পারে? কী জানি, বিশদভাবে ভেবে দেখতে হবে।

বিছানায় শুয়ে আগামীকালের কী কী করণীয় আছে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

আজকে হাবিলদার মাসুম আমাদের কয়েকজনকে বিস্ফোরকের প্রশিক্ষণ দিবে। সকালের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের পর সেলিম, সারোয়ার, সবুজ, ও আমি আমাদের তাঁবুর সামনে হাবিলদার মাসুমের অপেক্ষায় রইলাম। হাবিলদার মাসুম একটা চটের ব্যাগ হাতে এসে আমাদেরকে বসতে বললেন। আমরা সবাই তাকে ঘিরে অর্ধচন্দ্র হয়ে বসলাম।

হাবিলদার মাসুমের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মতো, গায়ের রঙ রোদ পোড়া তামাটে, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, ছোট ছোট গর্তে ঢুকা চোখ, ভোঁতা নাক, দেখতে অনেকটা উপজাতীয়দের মতো।

পরিচয় পালা শেষ হলে মাসুম ওস্তাদ ব্যাগ থেকে কয়েকটা টি.এন.টি (TNT) স্ল্যাব (slab), প্ল্যাস্টিক বিস্ফোরক (plastic explosive or semtex), কিছু প্রাইমার (primar), কয়েক ধরণের ডেটোনেটার, বিস্ফোরক দড়ি (explosive cord), দুই ধরনের ল্যান্ড-মাইন, ইত্যাদি বের করে আমাদের সামনে রাখল।

আমরা প্রাথমিক বিস্ফোরক প্রশিক্ষণের সময় এসবের নাম শিখেছি। আমাদের এখন জানা দরকার কী ভাবে সঠিক ভাবে এর ব্যবহার করতে হয়।

আমি হাবিলদার মাসুমকে বললাম, “আমারা এই জিনিসগুলো সম্পর্কে জানি। আমাদের যেটা জানা দরকার তা হলো কখন TNT ব্যবহার করতে হয়, কখন প্ল্যাস্টিক বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে এক্সপ্লোসিভ-কর্ড দিয়ে অনেক বিস্ফোরককে একই সাথে বিস্ফোরিত করতে হয়, বৈদ্যুতিক ডেটোনাটর কীভাবে ব্যবহার করে, কতদূর থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা যেমন, কংক্রিটের ব্রিজ, লোহার ব্রিজ, দালান, ইত্যাদি ধ্বংস করতে কতটুকে, কী ধরণের বিস্ফোরকের প্রয়োজন, ও কী পরিমাণ বিস্ফোরকের প্রয়োজন সেটা হিসাব করতে হয়, ইত্যাদি আমরা জানতে চাই।

হাবিলদার মাসুম আমাদের কথা শুনে একটু চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে, এক এক করে শুরু করি।

দুপরের খাবার জন্য প্রশিক্ষণের ছেদ পড়ল। খাওয়া শেষে আবার আমরা সমবেত হলাম। প্রশিক্ষণ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল। মোটামুটি সবই ঠিক ছিল শুধু কতটুকু বিস্ফোরকের প্রয়োজন সেই হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে হাবিলদার মাসুম ভাল জানে বলে মনে হলো না। বুঝতে পারলাম যে অনুমানের উপর নির্ভর করেই বিস্ফোরকের পরিমাণ সে নির্ণয় করে। পরের দিন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে মনে হয় না।

রাতের খাবার শেষ হলে আমি ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গিয়ে আজকের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে জানালাম। ক্যাপ্টেন আমাকে চেয়ারে বসতে বললেন। আমি তোমার প্রস্তাব নিয়ে ভেবেছি এবং মনে হয়েছে তোমার পরিকল্পনায় কাজ হবে। আমি মাসুম ও দুইজন সুবেদারের সাথে এই পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছি। তাছাড়া আমি হেড-কোয়াটার থেকে রেলের ইঞ্জিন ও বগি সম্পর্কে তুমি যে তথা চেয়েছিলে সেটা জেনেছি। ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য, সাথে যে কয়লা রাখার জায়গা থকে সেটা শুদ্ধ ১২০-ফুট। যাত্রী বহনের বগিগুলোর দৈর্ঘ্য ৮২-ফুট ও ওয়াগনের দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট।

আমি তথ্যগুলো সাথে সাথে আমার খাতায় লিখে রাখলাম। আমি আপনাকে রেলগাড়ির একটা ডায়াগ্রাম এবং কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগাতে হবে সেটা তৈরি করে দিব। কিন্তু কতটুকু বিস্ফোরক লাগবে সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না।আমি ক্যাপ্টেন কে বললাম।

ঠিক আছে তুমি আমাকে ডায়াগ্রামটা দেও, মাসুম যদি না পারে তাহলে আমি হেড-কোয়াটারের সাহায্য নিব। এখন আমাদের নির্ধারণ করতে হবে কাজটা করতে কতজন লোক লাগবে, ইত্যাদি। যদি সম্ভব হয় তাহলে এই ব্যাপারে একটু মাথা ঘামাও।

 ঠিক আছে রানা ভাই, আমি আরেকটা ছবি এঁকে আমার ধারণায় কোথায় কোথায় কতজন লোক লাগবে সেটা জানাব। এই খসড়া দেখে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।

কথা শেষ হলে আমি তাঁবুতে ফিরে এলাম।

হারিকেনের অস্পষ্ট আলোতে আঁকা আঁকির কাজ করা যাবে না, সকালে নাস্তার পরে করতে হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালের নাস্তার পর আমি তাঁবুতে আমার খাতা নিয়ে আঁকতে বসলাম। প্রথমটা বেশ সোজা, ইঞ্জিন ও বগিগুলোর দৈর্ঘ্য যেহেতু এখন জানা, কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগাতে হবে লাগাতে হবে সহজেই নির্ণয় করা যায়। কিছুক্ষণেই প্রথম কাজটা শেষ হলো। দ্বিতীয়টা একটু কঠিন। কেননা অনেক কিছু চিন্তা করার আছে। রেললাইনে বিস্ফোরক লাগানর পর অনেক লোক থাকার দরকার নেই। ৮-১০ জন থাকলেই হবে। অবশ্য আরও কিছু লোক রাখা যেতে পারে যদি ট্রেনের বহন করা গুরুত্বপূর্ণ মালামাল যদি করার ইচ্ছে থাকে। অথবা বিস্ফোরণের পরে যে সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য বেঁচে থাকবে তাদেরকে খতম করার জন্য। তবে আমার মনে হয় বিস্ফোরণের পর যথাশীঘ্র এলাকা ত্যাগ করাই শ্রেয়। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য ক্যাপ্টেনই নিবেন।

তাছাড়া কোথায় কোথায় ফক্সহোল খুড়তে হবে সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করলাম। ফক্সহোলের গভীরতা ও চওড়ায় কত হবে আমার থেকে ক্যাপ্টেনই ভাল বলতে পারবেন।

 ম্যাপ দুটো সারোয়ারকে দেখালাম এবং জানতে চাইলাম সে কোনো অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছে কি না। সারোয়ার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ দেখল, পরিশেষে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “নাহ, সেরকম কিছু তো দেখছি না। ঠিকই আছে। আমার একটি প্রশ্ন আছে। রাতের অন্ধকারে বিস্ফোরক লাগানর দূরত্ব ঠিক করব কেমন করে?“

তাই তো, এ কথা তো ভাবিনি,” আমার স্বগতোক্তি। অবশ্য সাথে সাথেই এর সমাধান হয়ে গেল। আমাদের সাথে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের দড়ি নিতে হবে তাহলে অন্ধকারে মাপা-মাপি করার ঝামেলা থাকবে না। আমি সারোয়ারকে ধন্যবাদ দিলাম।

  ঘড়িতে এখন দশটা বাজে। আমি ক্যাপ্টেনের তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। তাঁবুতে ক্যাপ্টেন একাই ছিলেন। আমাকে দেখে চেয়ারে বসতে বললেন। আমি খাতা বের করে ড্রয়িং দুটো দেখালাম।

ক্যাপ্টেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ডায়াগ্রাম দুটো দেখে আমাকে প্রশ্ন করলেন, “একটু বুঝিয়ে বলো।আমি তাকে কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগাতে হবে সেটা দেখালাম। তবে কোথায় কতটুকু বিস্ফোরক লাগবে সেটা যে আমি নির্ধারণ করতে পারিনি সেটাও জানালাম। মাসুম অথবা কোনো বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ লাগবে। এর পর কোথায় কোথায় ফক্সহোল তৈরি করতে হবে এবং কেন সেটি বুঝিয়ে বললাম।

ক্যাপ্টেন কোনো প্রশ্ন না করে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। আমার কথা শেষ হলে বললেন, “ঠিক আছে এটা এখন আমার কাছে থাক। আমি চিন্তা করে তোমাকে জানাব।

আমার সব কথা এখনও শেষ হয়নি, “আমাদের বিস্ফোরকগুলো ক্যাম্প থেকে প্রস্তুত করে নিয়ে যেতে হবে, রাতে সেখানে প্রস্তুত করা যাবে না। তাছাড়া, যারা এই বিস্ফোরক লাগানর দায়িত্বে থাকবে এদের অনেকেই আনকোরা, কাজেই তাদেরকে কেমন করে গর্ত খুঁড়বে, কেমন করে বিস্ফোরক গর্তে ঢোকাবে, কী ভাবে ডেটোনেটর লাগাবে, ইত্যাদি সবকিছু প্রশিক্ষণ করতে হবে এবং দেখতে হবে কাজ শেষ করতে কতক্ষণ সময় লাগে। দরকার হলে সম্পূর্ণ কাজ বেশ কয়েকবার প্রশিক্ষণ করতে হতে পারে।

ক্যাপ্টেন আমার কথা শুনে মাথা উপর-নিচু করে সম্মতি দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আমি একটু চিন্তা করি, তোমাকে পরে জানাব। আমি ক্যাপ্টেনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম।

দুপুরের খাবার আগে কিছু করার নেই। আমার সব অস্ত্র পরিষ্কার করতে বসলাম। তক্ষুনি মনে হলো সেলিম ও আমাকে সদ্য দখলকৃত একে-৪৭ দিয়ে কিছু গুলি ছুড়ে এই অস্ত্রের মতিগতি বুঝা দরকার। তাছাড়া তৃতীয় একে-৪৭ কাকে দেয়া যায়? আমার মনে হলো এটা সারোয়ারকে দেয়াই সবচেয়ে ভাল হবে কেননা এক নম্বর সেকশনের কম্যান্ডার সেলিম, তাকে একটি একে-৪৭ দেয়া হয়েছে। সারোয়ার দুই নম্বর সেকশনের কম্যান্ডার সেজন্য তাকেই তিন নম্বর একে-৪৭ দেয়া যুক্তিসংগত।

অস্ত্র পরিষ্কার করা শেষ হলেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো। ছড়াতে যেয়ে গোছল শেষ হলে আমি সেলিমকে একপাশে সরিয়ে সারোয়ারকে তৃতীয় এক-৪৭ দেবার সিদ্ধান্ত জানালাম। সেলিম আপত্তি করল না।

তাঁবুতে ফিরে আমি আমাদের ১৪-জনের সবাইকে ডাকলাম। সবাই এলে সারোয়ারকে একে-৪৭ দেবার সিদ্ধান্ত জানালাম। বললাম। আমি চাই আমাদের সবার কাছে যেন চাইনিজ অস্ত্র থাকে কারণ আমরা বাংলাদেশের ভিতরে থাকব তখন আমাদের অস্ত্রের গোলাবারুদের প্রধান যোগানদাতা হবে আমাদের শত্রু, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধানত চাইনিজ অস্ত্র ব্যবহার করে সেজন্য আমাদেরও চাইনিজ অস্ত্র থাকলে সুবিধা। আমরা ইনশাআল্লাহ আরও অস্ত্র দখল করব এবং পর্যায়ক্রমে সবাইকেই চাইনিজ অস্ত্র দেয়া হবে। প্রথমে সকল সেকশন কমান্ডাররা এই অস্ত্র পাবে।

আমি সবার সামনে সারোয়ারকে এক-৪৭ হস্তান্তর করলাম। সবাই তালি দিয়ে সারোয়ারকে শুভেচ্ছা জানাল।

আমি সেলিমকে সাথে নিয়ে নায়েক হাবিবের কাছে গেলাম। হাবিব ছিল আমাদের অস্ত্রাগারের দায়িত্বে। হাবিবের কাছ থেকে এক বাক্স (একটি বাক্সে ১,০০০ রাউন্ড গুলি থাকে) একে-৪৭-নের গুলি, ৫০-টা চাইনিজ পিস্তলের গুলি, ও ৫০-টা .৩৮ রিভলভারের গুলি নিলাম। চাইনিজ এসল্ট রাইফেলে (এক-৪৭) যে গুলি ব্যবহার করা হয় সেই একই গুলি চাইনিজ রাইফেল ও চাইনিজ লাইট-মেশিনগানেও ব্যবহৃত হয়। .৩২-র গুলি আছে কি না জানতে চাইলাম। নাহ, .৩২-র গুলি আমাদের অস্ত্রাগারে নেই।

আমার ইচ্ছা পরের দিন আমাদের তিন জনের সদ্য-প্রাপ্ত অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়ে পরীক্ষা করা। কিন্তু কোথায় করব? যেখানে ইচ্ছা সেখানে করা যাবে না। আশেপাশে লোকের বসবাস আছে। চিন্তার বিষয়। সবচেয়ে ভাল হয় বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে করলে।  

আমি রাতের খাবারের পরে ক্যাপ্টেনকে আগামীকাল বাংলাদেশের ভিতরে চা-বাগানে আমাদের এক-৪৭ থেকে গুলি ছুড়ে পরীক্ষা করার কথা জানালাম। আটটায় সময় ক্যাম্প থেকে বের হব।

ক্যাপ্টেন রানা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন, “অস্ত্র পরীক্ষা করা?” আমি উত্তর দিলাম, “এই অস্ত্র আমরা কেউ ব্যবহার করিনি। যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করার আগে এই অস্ত্র সঠিক ভাবে কেমন করে ব্যবহার করে সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন।ক্যাপ্টেন একটু চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে, আমিও তোমাদের সাথে যাব।

আজকে বিশেষ কাজ ছিল না। রাতের খাবার পরেই ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার পর সকাল সাতটার সময় সেলিম ও সারোয়ার আমার তাঁবুতে এলো। তাদের সেকশন দুটো আজকে আমাদের সাথে যাবে। দুটো সেকশন নেবার কারণ আমরা যখন গুলি ছোড়া প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকব তখন যেন অতর্কিত আক্রমণের ফাঁদে না পড়ি সেটা নিশ্চিত করা।

সারোয়ার এক-৪৭ সম্পর্কে ভাল জানত না। আমি তাকে কেমন করে অস্ত্রকে সম্পূর্ণ খুলে ভিতরের সব যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করার পর আবার জুড়তে হয় সেটা দেখানোর পর সারোয়ারকে নিজে করতে বললাম। প্রথমে সারোয়ার কিছু ভুল করলে সেলিম ও আমি সেই ভুল শুধরে দিলাম। দুই তিন বার চেষ্টার পর সারোয়ার নিপুণ ভাবে কাজটা করতে শিখল।

আমি তাদের দুজনকে দলবল নিয়ে ক্যাপ্টেনের তাঁবুর সামনে জড়ো হতে বললাম। সময়মত আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন তাঁবু থেকে বের হলে আমরা সবাই চা-বাগানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। চা-বাগান আমাদের ক্যাম্প থেকে প্রায় দেড়-মাইল দূরে। পৌঁছাতে বেশীক্ষণ লাগল না। চা-বাগানে ঢুকে আমাদের একটি জায়গা গুলি ছোড়ার জন্য আদর্শ মনে হলো। এটি চা-বাগানের একটি মাটির রাস্তা, প্রায় ১০০-গজের মতো রাস্তাটা সোজা, তারপর একটি ছোট টিলা যেখান থেকে রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। কাজেই এখানে গুলি ছুড়লে সব গুলি টিলাতে লাগবে ফলে লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি অন্য কোনো মানুষকে লাগার সম্ভাবনা নেই।

সারোয়ার একটা ৫-ফুট বাঁশ ও একটা টিন দিয়ে টার্গেট বানিয়ে এনেছিল। সেই টার্গেট লাগান হলো। আমরা প্রায় ১০০-গজ দূরে অবস্থান নিলাম।

প্রথমে আমি কিছু গুলি ছুড়ে তোমাদেরকে দেখাই।গুলি ছোড়ার আগে ক্যাপ্টেন অস্ত্র থেকে ম্যাগাজিন খুলে পরীক্ষা করলেন, তারপর ম্যাগাজিনটা আবার অস্ত্রে লাগালেন। এটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এটা দিয়ে দুভাবে গুলি ছোড়া যায়। এইটা হচ্ছে সেইফটি ক্যাচ (safety catch)এটা এখানে থাকলে (আমাদেরকে দেখিয়ে) অস্ত্র দিয়ে গুলি বের হবে না। সেইফটি ক্যাচ যদি এখানে থাকে তাহলে প্রতিবার ট্রিগার চাপলে একটি করে গুলি বের হবে ও এটাকে যদি এখানে নিয়ে ট্রিগার চাপা হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে গুলি বেরতে থাকবে।ক্যাপ্টেন একটু দম নিয়ে অস্ত্রের বিভিন্ন গুনাগুণ বর্ণনা করলেন, “এই অস্ত্রের গুলি ছোড়ার সর্বোচ্চ গতি প্রতি মিনিটে ৬০০ রাউন্ড। যদি একটা একটা করে গুলি কর তাহলে মিনিটে ৪০ রাউন্ড, আর যদি ছোট ছোট বার্স্টে গুলি কর তাহলে মিনিটে ১০০-রাউন্ড। এটা ককিং-লিভার।

ক্যাপ্টেন আমাদের তিন জনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। কোন প্রশ্ন না থাকার আবার আমাদেরকে প্রশ্ন করলে, “তোমাদের সাথের চারটি ম্যাগাজিনে সর্বোচ্চ কয়টি গুলি আছে, ১২০-টা, তাই না? এখন বলত যদি শুধু স্বয়ংক্রিয় ভাবে গুলি করো তাহলে চারটি ম্যাগাজিনের গুলি শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে?”

আমরা কেউ উত্তর দেয়ার আগেই সারোয়ার বলল, “প্রায় ১৫ সেকেন্ড।উত্তর ক্যাপ্টেন বললেন, “প্রায় ঠিক তবে আরেকটু বেশী হবে কেননা প্রত্যেক ৩০-টা গুলির পর ম্যাগাজিন পরিবর্তন করতে হবে। আচ্ছা ধরা যাক সব মিলিয়ে ৪৫-সেকেন্ড। এখন যুদ্ধ শুরুর ৪৫-সেকেন্ডেই যদি তোমাদের সব গুলি ফুরিয়ে যায় তাহলে তারপর তোমরা কী করবে?” ক্যাপ্টেন আমাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

আমি উত্তর দিলাম, “অবশ্যই সব সময় স্বয়ংক্রিয় ভাবে গুলি করা যাবে না।

ক্যাপ্টেন, “একদম ঠিক। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে একটা একটা করে অথবা ছোট ছোট বার্স্টে গুলি করা। আমি তোমাদেরকে একটু পরে দেখাব।

এবার ক্যাপ্টেন তার হাতের অস্ত্র কর্ক (cock) করলেন। তারপরে বললেন, “প্রথমে সিংগল সট করছি।তারপরে টার্গেট লক্ষ্য একটা একটা করে পাঁচটা গুলি ছুড়লেন। প্রত্যেকটা গুলি টার্গেটে আঘাত করল।

এবার দেখাচ্ছি ছোট বার্স্ট।ক্যাপ্টেন আবার গুলি ছুড়তে শুরু করলেন কিন্তু প্রত্যেক বার ট্রিগার চাপলে মাত্র ৩-৪-টা গুলি স্বয়ংক্রিয় ভাবে বের হচ্ছে। প্রায় সকল গুলি টার্গেটে লাগল।

এই বার স্বয়ংক্রিয় গুলি।ক্যাপ্টেন ট্রিগারে চাপ দিলেন এবং ট্রিগার চেপে ধরে রইলেন। ম্যাগাজিন খালি না হওয়া পর্যন্ত গুলি বেরতে থাকল। গুলি শেষ হলে ক্যাপ্টেন খালি ম্যাগাজিন অস্ত্র থেকে খুলে তার এ্যামুনেশন ভেস্ট থেকে আরেকটি ম্যাগাজিন বের করে অস্ত্রে লাগিয়ে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “এবার তোমাদের পালা।

আমি প্রথমে এগিয়ে গেলাম। আমি স্টারলিং দিয়ে বেশ কিছু গুলি ছুড়েছি, কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই স্বয়ংক্রিয় ভাবে। এবার প্রথমে ক্যাপ্টেনের মতো সিংগল সট বা একটা একটা করে পাঁচটা গুলি ছুড়লাম। ছুড়তে কোনো অসুবিধা হলো না। তিনটে গুলি টার্গেটটা লাগল। তারপর ছোট বার্স্টে গুলি ছুড়লাম। অনুভব করলাম স্টারলিঙের তুলনায় এটার ধাক্কা অনেক বেশী, কিন্তু এমন না যে অস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এবার অবশ্য সব গুলি টার্গেটে লাগল না। তৃতীয় বার স্বয়ংক্রিয় ভাবে গুলি ছুড়লাম। কিন্তু আবার অস্ত্রের নিশানা নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হলো। আগের তুলনায় অস্ত্র অনেক কাঁপে এবং প্রায় সব গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

আমার পর সেলিম ও শেষে সারোয়ার গুলি ছুড়ল। আমি সাথে করে .৩৮ রিভলভার নিয়ে এসেছিলাম। আমি রিভলভার বের করে গুলি ছুড়তে উদ্যত হলে ক্যাপ্টেন আমাকে থামালেন, “১০০-গজ দূর থেকে রিভলভার দিয়ে গুলি করে কোনো লাভ নেই, শুধু গুলির অপচয়। তুমি টার্গেট থেকে ২০-গজ দূরত্বে যাও, সেখান থেকে গুলি কর। আমরা চার জন টার্গেটের আনুমানিক ২০-গজের কাছাকাছি পৌঁছে রিভলভার দিয়ে ছটা গুলি ছুড়লাম। মাত্র একটি গুলি টার্গেটের এক কোনায় লাগল। ক্যাপ্টেন হাসতে শুরু করলেন, “পিস্তল বা রিভলভার দিয়ে গুলি ছুড়ে নিশানা ভেদ করতে হলে অনেক অনুশীলন করতে হয়, এটা রাইফেলের মতো না। চল আজকে ফিরে যাই।আমি অবশ্য তখন বেশ বিব্রত, ছয়টা গুলির মাত্র একটা টার্গেটে লাগল? মাত্র ২০-গজ দূর থেকে?

সাড়ে এগারোটার সময় ক্যাম্পে পৌঁছলাম। ক্যাপ্টেন বিদায় নেবার সময় বললেন, “দুপুরের খাবার শেষ হলে আমার তাঁবুতে এসো, দরকারি কথা আছে।

ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মতো খাবার পরে ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গেলাম। ক্যাপ্টেন ইশারায় আমাকে চেয়ারে বসতে বললেন। তিনি মনোযোগ সহকারে কয়েকটা কাগজ দেখছেন।

আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতে রইলাম। "তোমার ডায়াগ্রামগুলো আমি ভাল ভাবে দেখেছি। কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগাতে হবে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু কোথায় কোথায় কতজন লোক লাগবে সে ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন করেছি।" ক্যাপ্টেন ডায়াগ্রামটা টেবিলে রেখে দুই কনুই টেবিলে রেখে একটু সামনে ঝুঁকে বসলেন; তার দেখাদেখি আমিও সামনে ঝুঁকে বসলাম।

ক্যাপ্টেন তার ডায়াগ্রামে একটি পেনসিল দিয়ে নির্দেশ করে আমাকে বুঝাতে শুরু করলেন। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় দিলাম।

ও আচ্ছা, কোথায় কতটুকু বিস্ফোরক লাগবে তার একটা অনুমান হেড-কোয়াটার থেকে আমি পেয়েছি। ইঞ্জিনের জন্য ৫০-পাউন্ড ও বগিগুলোর জন্য ৩০-পাউন্ড। তাহলে আমাদের মোট ১৭০-পাউন্ড TNT লাগবে। আমার মনে হয় ২০০-পাউন্ড হলে ভাল হয়, তুমি কী বলো?”

তাহলে এই অতিরিক্ত ৩০ পাউন্ড বিস্ফোরক ইঞ্জিনে ও বগিগুলোতে ভাগ করে দেয়া যায়, ৫-পাউন্ড করে প্রত্যেক বগির নীচে, ও দশ পাউন্ড ইঞ্জিনের নীচে?” আমি প্রস্তাব করলাম। ক্যাপ্টেন একটু চিন্তা করে সম্মতি দিলেন।

তাঁবুতে ফিরে এসে আমি হিসাব করতে বসলাম। প্রত্যেকটি এক পাউন্ড TNT ব্লকের দৈর্ঘ্যে ৫-ইঞ্চি, প্রস্থে ৩-ইঞ্চি, ও উচ্চতায় ২-ইঞ্চি। ইঞ্জিনের জন্য তাহলে মোট ৬০-টি TNT ব্লক লাগবে এবং এটাকে একটা প্যাকেটের মতো করলে এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ও উচ্চতা যথাক্রমে হবে ১৮-ইঞ্চি, ১০-ইঞ্চি, ও ২০-ইঞ্চি। একই ভাবে অন্য চারটি হবে যথাক্রমে ১০, ১৪, ও ১০ ইঞ্চি। কাজেই আমাদের প্রশিক্ষণের সময় এই রকম এক বা একাধিক প্যাকেট তৈরি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী দিয়ে এই প্যাকেট বানানো যায়? একটা হতে পারে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা। হাঁ, সেটা বানানোই সবচেয়ে সুবিধা হবে, বাঁশ ও দড়ি।

আমার তাঁবুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের চটপটে ছাত্র আমানতকে ডেকে এরকম দুটি বাঁশের বাক্স তৈরি করতে বললাম। বলে দিলাম কোনো ধাতব পদার্থ যেন ব্যবহার না করে।

এই টাকাটা রাখ, বাঁশ আরে দড়ি কিনতে লাগবে।

কোনো চিন্তা করবেন না সোহেল ভাই, কখন দরকার?” তার সপ্রতিভ উত্তর।

কালকে দুপুরের মধ্যে হলে ভাল হয়।

 "ঠিক আছে," বলে আমানত চলে গেল।

এসব করতে করতে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। ঘড়িতে এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে।

রাতে খাবার পর আমি আবার ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গিয়ে দেখলাম ক্যাপ্টেন হাবিলদার মাসুমের সাথে কথা বলছেন। আমাকে দেখেই বললেন, “সোহেল, তোমাকেই দরকার, আমি মাসুমের সাথে তোমাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কথা বলছি। তুমি বস।আমি চেয়ারে বসলাম। আজকে হ্যাজাক লাইটের উজ্জ্বল আলোতে তাঁবুর সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আমি কিছু হিসাব করে এনেছি।আমি সাথে আনা বিস্ফোরক, বিস্ফোরক লাগানোর জনা কতটুকু গর্ত করতে হবে, ইত্যাদির হিসাব ক্যাপ্টেন ও মাসুমকে দেখিয়ে বুঝিয়ে বললাম। আমি ইতোমধ্যে বিস্ফোরকের জন্য দুটি বাঁশের খাঁচা তৈরি করতে দিয়েছি। বাঁশের খাঁচা মাইন ডিটেকটারে ধরা পড়বে না।

ক্যাপ্টেন ও মাসুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কাগজগুলো দেখে বললেন, “বাহ, অনেক কাজই তো দেখি এগিয়ে রেখেছ।ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকিয়ে বেশ প্রশংসাসূচক ভাবে মাথা নাড়িয়ে হাসলেন। মাসুমের দিকে তাকাতেই বুঝলাম মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। মাসুম এখন আমাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। সুবেদার মেজর বশীরের বৈরিতার কথা মনে পড়ল। আমার মাসুমকে সাথে নিয়ে এই কাজগুলো করা উচিৎ ছিল যেন কৃতিত্বটা সে নিতে পারত। যা হবার তা হয়েছে, আমার ভবিষ্যতে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। আমরা এদের সহযোগিতা চাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই না।

ঠিক হলো আগামীকাল দুপুরের খাবার পরে আমাদের মাইন লাগানোর প্রশিক্ষণ শুরু হবে। গর্ত খুঁড়তে হলে প্রত্যেক দলে তিন জন থাকতে হবে; দুজন গর্ত খুঁড়বে এবং তৃতীয় জন গর্ত খোঁড়ালে যে মাটি বের হবে সেটা একটি চটের বস্তায় সংগ্রহ করবে যেন গর্ত খুঁড়ার কোনো চিহ্ন না থাকে।

প্রথম বিস্ফোরক লাগানোর (ইঞ্জিন ধ্বংস করার জন্য) দায়িত্ব  হাবিলদার মাসুমের কেননা সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। মাসুমের পরে পর্যায়ক্রমে থাকবে সেলিম সারোয়ার, সবুজ ও সর্ব শেষে আমার দল। আমার দলের অন্য দুজন সদস্য হচ্ছে ছাত্র আমানত ও ট্র্যাক চালক আলী। সেলিম, সারোয়ার, ও সবুজ প্রত্যেকে তাদের দলের জন্য আরও দুজনকে নির্বাচন করবে।

প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আমার এক বিশেষ খুঁতখুঁতে ভাব আছে, বিশেষ করে যখন কোনো কাজ প্রথমবার করা হয়। আমরা এই কাজ আগে যদি অনেকবার করে থাকতাম তাহলে হয়ত একবার প্রশিক্ষণ করলেই আমি সন্তুষ্ট হতাম।

তাছাড়া, আমরা যখন বিস্ফোরক লাগাব তখন আমাদের নিরাপত্তার জন্য রেল লাইনের দুই প্রান্তে প্রতিবন্ধকতার প্রয়োজন হবে যেন অতর্কিতে শত্রুর আক্রমণের শিকার না হই। এই দায়িত্ব ক্যাপ্টেন নিজেই নিলেন।

কথা শেষ হলে আমি ও মাসুম একসাথে তাঁবু থেকে বের হলাম। আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে মাসুমকে দিলাম, নিজেও একটা ধরালাম। তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললাম। আমি তার সাথে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই প্রচেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে। এখন বেশ রাত হয়েছে, মাসুমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁবুতে ফিরলাম। ঘুম আসতে বেশীক্ষণ লাগল না।

পরের দিন সকালে নাস্তার পর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সেলিম, সারোয়ার, ও মাসুমকে নিয়ে তাঁবুতে বসলাম। আমি চিন্তা করছিলাম রাতের অন্ধকারে কালক্ষেপণ না করে প্রথম চেষ্টাতেই বিস্ফোরকের জন্য সঠিক মাপের গর্ত কীভাবে খোঁড়া যায়। আমার মাথায় একটা ধারণা ছিল, কিন্তু প্রথমে কিছুই না বলে সবার কাছে জানতে চাইলাম। সবার বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। তারপরে হঠাৎ মাসুমকে বললাম, “আচ্ছা মাসুম ওস্তাদ, বাঁশ দিয়ে একটা আয়তকার ফ্রেম তৈরি করলে কেমন হয়?” আমি খাতা বের করে একটা আয়তকার ফ্রেম আঁকলাম। এই ফ্রেমটা ঠিক আমাদের সাথের বিস্ফোরকের প্যাকেটের মাত্রায় হবে। এই ফ্রেমটা দিয়ে খুব সহজেই নিখুঁত মাপের গর্ত খনন করা যাবে।আমার কথা শুনে মাসুম সাথে সাথে যোগ করল, “আরেকটা বাঁশের কাঠি আমাদের সাথে থাকবে যেটা দিয়ে গভীরতা কতটুকু হবে সেটা নির্ধারণ করা হবে।

আমি সাথে সাথেই বললাম, “মাসুম ওস্তাদ, একেবারেই ঠিক।হাবিলদার মাসুম আমাদের প্রশংসা শুনে বেশ খুশী হলো।

এই EPR-এর সদস্যরা প্রায় সকলেই অশিক্ষিত সাদাসিধা লোক। তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরবাড়ি, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে বিভিন্ন প্রত্যন্ত সীমান্তে পাহারায় থাকতে হয়। আমরা শহরের ছেলে; আমাদের বেশভূষা, কথাবার্তা, ও চালচলন তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের ব্যবহারে সামান্য অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিও তাদের চোখে উদ্ধত অহংকার মনে হতে পারে। তাছাড়া ক্যাপ্টেন রানার কাছে আমার অবাধ যাওয়া-আসা তাদের অনেকের কাছেই একটু হলেও দৃষ্টিকটু লাগতে পারে; কেননা সেনাবাহিনীতে অফিসার ও জোয়ানদের মাঝে বিস্তর পার্থক্য।

সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনীতে আমাদের মতো ছাত্র যোদ্ধারা এক বিরাট সমস্যা। আমরা ঠিক সিপাইও না আবার অফিসারও না। আমাদের অবস্থান এই দুইয়ের মাঝখানে কোথাও। আমাদের অনেকেই সামরিক বাহিনীর অনমনীয় নিয়ম কানুন মানতে চায় না।  

দেখতে দেখতে সাড়ে-এগারোটা বেজে গেল আর ঠিক তক্ষনি আমানত হাজির হলো, সাথে দুইটা না, তিনটা বাঁশের তৈরি চারকোনা ঝুড়ির সাদৃশ্য ফ্রেম। ফ্রেমের কোনাগুলো বাঁশের ছিলকা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। আমি  ফ্রেমগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলাম। ফ্রেমের উপরের যায়গাটা খোলা, বাকী পাঁচ দিক বাঁশের মিহি জ্বাল দিয়ে ঘেরাঅনেকটা চারকোনা বাঁশের ঝুড়ির মতো। আমি দেখে খুব খুশী হলাম। আমানত দুই টাকা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, “এগুলো করতে তিন টাকা লেগেছে।আমি তার পিঠ চাপড়ে দিলাম। আজকে দুপুরের খাবার পর বিস্ফোরক লাগানোর প্রশিক্ষণ শুরু হবে।

আমাদের প্রত্যেক বিস্ফোরক লাগানর দলে তিন জন থাকবে। আমার দলে অন্য দুজন আমানত ও আলী। দুপরের খাবারের পর আমরা ১২-জন ও মাসুম সহ তিন জন, মোট ১৫-জন একসাথে জড়ো হলাম।

প্রত্যেকে দল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয় বার গর্ত খুড়ে নকল বিস্ফোরক ঢুকিয়ে আবার গর্ত সঠিক ভাবে বন্ধ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু প্রথম দিকে অনেক কিছুই ভুল হয়ে গেল। কখনো গর্ত ঠিক মতো হয় না অথবা গর্তের মাপ কম বা বেশী হয়ে যায়,  যে দিক  উপরে থাকার কথা সেটা নীচে চলে যায়, ঠিক মতো মাটি পরিষ্কার করা হয় না, ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যায় আমরা সবাই ক্লান্ত। কিছুক্ষণ পরে খাবার সময় এলে সেদিনের মতো প্রশিক্ষণ শেষ হলো। বারবার গর্ত তৈরি করা ও আবার গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। ফলে, আমরা ভীষণ পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত।

আজকে আমাদের দলের স্ট্যান্ড-টু নেই। ছড়াতে গিয়ে সবাই গোছল শেষে খাবার পরপরই শুয়ে পড়লাম।

পরের দিন আবার নাস্তার পরে গর্ত খোঁড়া ও বন্ধ করা শুরু হলো। আজ সবাই আগের তুলনায় সহজেই কাজ সমাপ্ত করল। প্রথম দিকে যেখানে গড়ে সময় লাগছিল ৪৫-মিনিট; প্রায় নয় বার প্রশিক্ষণের পরে সময় ২০-মিনিট এসে ঠেকল। কিন্তু এখানেই প্রশিক্ষণ শেষ হলে চলবে না। আমাদের অপারেশন হবে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে। কাজেই, এবার রাতের আধারে কীভাবে দক্ষতার সাথে এই কাজ করতে হবে সেটা রপ্ত করতে হবে।

রাতের প্রশিক্ষণ চার দিন চলল। চতুর্থ দিন আমার মনে হলো যে এতক্ষণে আমারা অভিযানের জন্য প্রস্তুত।

রাতে বিস্ফোরক লাগান দিনের চেয়ে অনেক কঠিন। রাতে যেহেতু চোখের দৃষ্টি ভালোভাবে কাজ করে না, ফলে, মূল ভরসা পেশী-স্মৃতি ও হাতের স্পর্শ। পেশী-স্মৃতি অর্জনের একমাত্র উপায় বার বার একই কাজ প্রশিক্ষণ করা। কিন্তু তা স্বত্বেও কিছু আলোর প্রয়োজন হবে, বিশেষ করে মূল বিস্ফোরকে প্রাইমার ও ডেটোনেটর লাগানর সময়, ও তারপর সব বিস্ফোরক লাগান শেষ হলে কোথাও কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না তা পুঙ্খানুপুঙ্খু ভাবে পরীক্ষা করার জন্য। এত কষ্ট করে বিস্ফোরক লাগানর পর আমাদের কাজের সামান্য গাফিলতির জন্য শত্রু যদি বিস্ফোরক লাগান হয়েছে বুঝতে পারে তাহলে সব পরিশ্রম পণ্ড হবে।

প্রশিক্ষণ শুরুর ছয় দিন পরে মনে হলো আমাদের দল এখন অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। আমি হাবিলদার মাসুদকে বললাম, “মাসুম ওস্তাদ, ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলেন যে আপনার দল এখন অপারেশনের জন্য প্রস্তুত এবং আপনি ক্যাপ্টেন সাহেবকে আমাদের দক্ষতা দেখতে আমন্ত্রণ করেন।আমার কথায় মাসুম বেশ খুশী হলো। হাঁ, ঠিকই, ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখান দরকার,” বেশ উৎফুল্ল হয়ে মাসুম উত্তর দিল।

আমাদের যখন প্রশিক্ষণ শেষ তখন রাত প্রায় ১২-টা। আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কোন রকরে তাঁবুতে ঢুকে যে কাপড় পরে ছিলাম সেই কাপড়েই বিছানায় সটান শুয়ে মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন নাস্তার পর আমি যখন সিগারেট ফুঁকছি, হাবিলদার মাসুম আমার তাঁবুতে এলো। মাসুম আমাকে বলল, “সোহেল ভাই, চলেন ক্যাপ্টেন সাহেব কে বলি (বিস্ফোরক লাগানতে আমাদের প্রস্তুতি)।

হাবিলদার মাসুমের কথা শুনে মনে মনে হাসলাম। একটু চেষ্টা করলেই যে কত সহজে একজনকে বন্ধু বানানো যায়। প্রয়োজন হয় শুধু শ্রদ্ধা, সম্মান, ও তাদের কাজের প্রশংসা। একজন দলনেতার কখনই নিজেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে জাহির করার প্রবণতাটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই দলনেতার একটি প্রধান কর্তব্য।

ঠিক আছে, চলেন,” আমি হাতের সিগারেটটা তাঁবুর বাহিরে ছুড়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মাসুম ওস্তাদ সহ আমি ক্যাপ্টেনের তাঁবুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

পৌঁছে দেখি ক্যাপ্টেন সাহেব সুবেদারদের সাথে মিটিং করছেন। আমরা তাঁবুতে না ঢুকে তাঁবুর বাহিরে অপেক্ষায় রইলাম।

মাসুম ওস্তাদ, বিয়ে শাদী করছেন?” আমার কথা শুনে মাসুম ওস্তাদ মনে হয় একটু লজ্জা পেলেন, “আর কী বলব, মার জোরাজুরিতেই বিয়ে করতে হইল।আমাকে পাল্টা প্রশ্ন, “আপনি করছেন নাকি?” আমি মাথা ঝাঁকিয়ে, ঠোট একটার উপরে আরেকটা উঠিয়ে উত্তর দিলাম, “না ভাই, পারলাম কই?” মাসুম ওস্তাদ আমার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হয়ে সান্ত্বনা দিল, “আরে, হবে হবে, একটু ধৈর্য ধরেন। বয়স তো বেশী হয় নাই, সবুর করেন, সবুর করেন, সবুরে মেওয়া ফলে।

একটু পরে তাঁবু থেকে সবাই বের হলে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ক্যাপ্টেন সাথে সৌজন্য বিনিময়ের পর ক্যাপ্টেনকে মাসুম আমাদের প্রস্তুতির কথা জানাল। আমি যোগ করলাম, “আপনাকে আমাদের প্রস্তুতি দেখলে ভাল হয়।“ “ঠিক আছে আজকে রাত আটটায় আমি দেখতে আসব।ক্যাপ্টেন উত্তর দিলেন।

সেদিন রাতে খাবার পর নির্ধারিত সময়ে চার জন সুবেদার পরিবেষ্টিত হয়ে ক্যাপ্টেন পূর্বনির্ধারিত স্থানে এলেন।

এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশেপাশের কিছুই দেখা যায় না। ক্যাপ্টেন ও সুবেদার সাহেবদের বসার জন্য কতগুলো বাঁশের মোড়া, সেখানে সবাই বসলেন। মাসুমকে ডেকে ক্যাপ্টেন কাজ শুরুর নির্দেশ দিলে আমরা সবাই বিস্ফোরক লাগাতে শুরু করলাম। আমাদের যে তিন-ব্যাটারির টর্চ-লাইট ছিল, সেই লাইটগুলোর সামনের কাচে কাগজ লাগিয়ে আলো কমিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হলো। আমাদের দুটো হ্যাজাক-লাইট জ্বালিয়ে ক্যাপ্টেন তার দলবল সহ যেখানে বিস্ফোরক লাগান হয়েছে সে যায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। পরিশেষে বললেন, “এখন ভাল বোঝা যাবে না, সকালের আলোতে দেখতে হবে।ক্যাপ্টেনের কথা ঠিক, পাকিস্তানিরাও সকালের উজ্জ্বল আলোতেই এ এলাকা মাইন-ডিটেকটার দিয়ে পরীক্ষা করবে।

ক্যাপ্টেন তাঁবুতে ফিরতে ফিরতে আমাকে বললেন, “আমার শুধু তোমাদের টর্চ-লাইটগুলো পছন্দ হলো না। এই লাইটের আলো এতো বেশী যে আলো কমানোর চেষ্টা করার পরও অনেক আলো বের হয়। আমি তোমাদের জন্য কয়েকটা পেনসিল-লাইট জোগাড় করতে চেষ্টা করব।

তাঁবুতে ফেরার পর আমরা সবাই যার যার তাঁবুতে ঘুমাতে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালের নাস্তার পর আবার আমরা সবাই আগের রাতের জায়গায় সমবেত হলাম। প্রথমে ক্যাপ্টেন দূর থেকে সম্পূর্ণ এলাকাটা দেখলেন; তারপর ধীর গতিতে যে এলাকায় বিস্ফোরক লাগান হয়েছে সে দিকে এগিয়ে গেলেন-তার পেছনে অন্যান্যরা।

কিন্তু কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তিনি রাতে দেখা যায়গাটা খুঁজে পেলেন না। কী ব্যাপার? বিস্ফোরকগুলো কোথায়?” তিনি জানতে চাইলেন।

আমি মাসুমকে ইশারায় ক্যাপ্টেনকে দেখাতে বললাম। ক্যাপ্টেন যদিও প্রায় বিস্ফোরকের উপরেই হাটছিলেন, তা স্বত্বেও বিস্ফোরকের সঠিক অবস্থান সনাক্ত করতে পারেননি। আমরা সাফল্যের সাথে পরীক্ষায় উতরে গেলাম।

একটি কথা আগে বলা হয়নি, আমাদের ক্যাম্প প্রত্যেক দিন দুটি টহল দল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। এই দলের সাথে মাঝে মাঝে সীমান্তে পাহারায় নিয়জিত পাকিস্তানি সৈন্য অথবা রাজাকারদের সাথে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ত। রাজাকারদের আমরা থোড়াই পরোয়া করতাম। এই রাজাকারগুলো ছিল অনেকটা নেড়ি কুত্তার মত। রাজাকাররা আমাদের দেখলে দূর থেকে কিছু গোলাগুলি করে পালাত। কিন্তু এই গোলাগুলির আওয়াজ শুনে মাঝে মাঝে পাকিস্তানি সৈন্যদের আবির্ভাব হতো, অথবা পাকিস্তানি গোলান্দাযরা আমাদেরকে গোলাবর্ষণ করত। এর ব্যতিক্রম অবশ্য মাঝে মাঝে হতো বিশেষ করে যদি তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে থাকত। তখন অবশ্য তাদের পক্ষে, খুব সম্ভবত পাকিস্তানিদের ভয়ে, সহজে যুদ্ধ থেকে পালান সম্ভব হতো না।

যাই হোক, আজকে সেলিম ও সরোয়ারের দুটি সেকশন একসাথে টহলে যাবে। আমিও তাদের সাথে যোগ দিব ঠিক করলাম। আমরা বিকালে ফিরে আসব, সাথে দুপুরের খাবার জন্য চিড়া ও গুড় নিয়েছি।

সীমান্ত পার হবার পর এই এলাকার বেশ কিছুটা জায়গা ঝোপ ঝাড়, গাছ পালা, বিভিন্ন ধরনের আগাছা, ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ। বুঝতে কষ্ট হয় না যে এই এলাকা এখন জনমানবশূন্য।

আমি সহ সেলিম ও সরোয়ারের সেকশন মিলে মোট ২১-জন। প্রায় সবার কাছেই স্বয়ংক্রিয় অথবা আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকলেও একমাত্র ব্যতিক্রম চুনারুঘাটের গেদু মিয়া। গেদু মিয়া সেই প্রথম থেকে যে ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করছে অনেক চেষ্টা করেও সেই রাইফেল পরিবর্তন করান যায়নি। আমিও আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করিনি।

আজকে আমি চাচ্ছিলাম আমরা যেন কোনও গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের দলের সবার এই গোলাগুলিতে অভ্যস্ত হতে হবে। আমাদের এখনকার দল আর শুধু আজিমপুরের বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, আগে নির্দ্বিধায় একে অন্যের উপরে নির্ভর করতে পারতাম, কিন্তু এখন সেটা আশা করা নেহাতই বোকামি হবে।

গত কয়েক সপ্তাহ থেকে যদিও আমরা দলের সবাই গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল শিখছিলাম, তা স্বত্বেও সরাসরি যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া এই শিক্ষা পরিপূর্ণতা পাবে না। কাজেই দলনেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব দলের সদস্যদের সঠিক ভাবে প্রশিক্ষিত করা।

সীমান্ত থেকে প্রায় পাঁচ মাইল পরে একটা ট্রেন লাইন আছে। এখন লাইনের আশেপাশে কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। আমরা একটি গেরস্থের পরিত্যক্ত বাসার ভিতরে অবস্থান করছি। এই কয়েক মাসে ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত থাকায় চারিদিক বিভিন্ন আগাছা, গাছপালা, ও ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাসার ভিতরে কেউ অবস্থান করলেও বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

আমরা বেশ কিছুক্ষণ রেললাইন পর্যবেক্ষণ করছি, এমন সময় ১৪-১৫ জনের এক পাকিস্তানি টহল দলকে রেললাইন দিয়ে হেটে আসতে দেখলাম। এই দলের কিছু যে রাজাকার সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। আমার এই তথাকথিত পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখে কেমন যেন সন্দেহ হলো কেননা ঠিক এই সময়ে পাকিস্তানিরা পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে কিছু আধা-সামরিক মিলিশিয়া এনেছিল যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য। মিলিশিয়াদের খুব একটা উন্নত প্রশিক্ষণ ছিল না। এদেরকে সাধারণত বিভিন্ন স্থাপনা পাহারার দায়িত্বে রাজাকারদের সাথে নিয়জিত করা হতো।

এদের দেখার পর চিন্তা করছিলাম কী করা যায়? আমরা যদি চুপচাপ এই বাসার আড়ালে বসে থাকি তাহলে হয়ত এই টহল দল নির্বিঘ্নেই আমাদের সামনের রেললাইন দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যাবে। তাই যদি হয় তাহলে আমদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয়ই চোখের সামনে দিয়ে এরকম এক লোভনীয় শত্রুর দলকে ছেড়ে দেয়া না?

এখনও শত্রুর টহল দল আমাদের থেকে বেশ দূরে। আমি সেলিম ও সরোয়ারের সাথে সলাপরামর্শ করলাম। আজিমপুরে মারামারির সময় আমাদের এইটি বহুল পরীক্ষিত পদ্ধতি ছিল। বহিরাগত কেউ আজিমপুর কলোনিতে আক্রমণের অভিপ্রায়ে এলে আমরা তিন ভাগে ভাগ হতাম। দুই ভাগ দালানের আড়ালে লুকিয়ে রইত আর আরেক দল শত্রুর সামনে লম্ফঝম্ফ করত। প্রতিপক্ষ আমাদেরকে এই স্বল্প সংখ্যায় দেখে উৎসাহিত হয়ে আমাদের কে ধাওয়া করত এবং কিছুটা সামনে এগিয়ে এলেই আমাদের পরিপূর্ণ শক্তির সামনে পড়ত। আমারা তখন সহজেই তাদেরকে তুলা-ধুনা করে ফেরত পাঠাতাম।

আমরা একমত হলাম।

আমরা তাড়াতাড়ি তিনটি দলে ভাগ হলাম, দুটি দল আমাদের কে সামনে রেখে বেশ পেছনে চলে গেল। সবুজ, ইব্রাহিম, আমানত, ও আমি গেরস্তের বাড়ির আশেপাশে গুলি ঘড়ার জন্য ঘুপটি মেরে রইলাম।

আমাদের এই চার জনের দলের উদ্দেশ্য সামনের পাকিস্তানি টহল দলকে প্রলুব্ধ করে আমাদের দিকে টেনে আনা যেন দলের বাকী সদস্যদের পেতে রাখা ফাঁদে এদেরকে ধরা যায়।

আমরা যখন আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে অবস্থান নিয়েছি তখনও টহল দল কিছুটা দূরে। আমরা ঘুপটি মেরে বসে রইলাম। আমাদের ছোট দলকে ফিসফিস করে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললাম, “আমাদের উদ্দেশ্য শুধু এদেরকে খোঁচা দেয়া যেন আমাদেরকে দুর্বল মনে করে আমাদের পিছু নেয়। খবরদার এদের সাথে বেশীক্ষণ গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়বে না।

আমি অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করছি, আমার ডানে স্টারলিং হাতে সবুজ, আমার বামদিকে SLR হাতে কলেজ ছাত্র আমানত, ও তার পরে আরেকটি SLR হাতে গাড়ির ম্যাকানিক ইব্রাহিম। সবুজ আমাদের দলের পুরাণ সদস্য, তাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। কিন্তু আমানত, ইব্রাহিম, ও ইসহাক গোলাগুলি শুরু হলে কী করবে বলা মুশকিল। প্রথম গুলির  সামনে পড়লে বেশীরভাগ লোকের প্রাথমিক প্রবৃত্তি হচ্ছে পালানযুদ্ধ করা না। কাজেই আজকেও সে রকম কিছু ঘটলে আশ্চর্য হব না। কিন্তু এই পালানটাও এক ধরণের শিক্ষা। এই ভাবে কয়েকবার পালাতে পালাতেই পরিণতিতে একজন সাহসী যোদ্ধায় রূপান্তরিত হবে। অবশ্য মাঝে মাঝে এই ছকের পরিবর্তনও দেখা যায়, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম।

আমি সবাইকে সিংগল-শর্ট করতে বললাম। প্রথমে আমি গুলি ছুড়লাম। আমরা কয়েকটা গুলি ছুড়তেই রেললাইন থেকে সব পাকিস্তানি/রাজাকার একযোগে আমাদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। আমি সবাইকে গাছের আড়ালে থেকে মাঝে মাঝে দু-একটা গুলি করতে বললাম। রেললাইনের অপর পাশে অবস্থান নিয়ে শত্রুর ছোড়া গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে শো-শো করে চলে যাচ্ছে। আমার পাশেই আমানত গাছের আড়ালে বসে ছিল। আমি তার দিকে তাকালাম; নাহ, ভয় কোথায়? দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি দেখে বেশ অবাক হলাম, কেননা এরকম পরিস্থিতিতে প্রায় সকলেই ভয় পায়। অন্য নতুন দুজনও ভয় পেলেও পালিয়ে যায়নি।

এই ভাবে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে গোলাগুলি ছোড়ার পর আমাদের থেকে সাড়া না পেয়ে শত্রুর গুলিতে ভাটা পড়ল।

আমি মনে মনে হাসলাম। এখন নিশ্চয়ই ব্যাটারা যায়গাটা দেখতে আসবে। আমি ইশারায় সবাইকে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে যেতে বলে নিজে ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে থাকলাম। এখনও তাদের দু-একজন মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত গুলি করছে। এই দলে ১৪-১৫ জন। বেশীরভাগ লোকের কাছে চাইনিজ রাইফেল, কয়েক ননের কাছে একে-৪৭, অল্প সংখ্যক ৩০৩ রাইফেলও দেখতে পেলাম। তারা রেল লাইন থেকে নেমে আমাদের দিকে আসছে, প্রায় ২০০ গজ দূরত্বে।

আমি হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে ফিরে সেলিমের পাশে অবস্থান নিলাম। এখন পাকিস্তানিদেরকে আমরা গাছপালার ফাঁক দিয়ে আবছা দেখতে পাচ্ছি। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে, এখনও গুলি ছুড়ার উপযুক্ত সময় আসেনি। সেলিম গুলি ছোড়ার জন্য নিশপিশ করছে, কিন্তু আমি  ইশারায় নিষেধ করলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে খাকী প্যান্ট ও কয়লা রঙের শার্ট পরা লোকটা সামনের ঝোপ থেকে বের হয়েই ২০-গজ দূরে আমাকে তার দিকে একে-৪৭ নিশানা করে থাকতে দেখল।

এর পরে আমাকে কিছু বলতে হয়নি। আমার প্রথম ছোট বার্স্ট সামনের সৈন্যের বুক ঝাঁঝরা করে ফেলল, সে হয়ত মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পেরেছিল যে তারা আমাদের ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু তখন তার কিছুই করার নেই।

আমাদের আক্রমণ এতটাই আকর্ষিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল যে প্রায় সবার হাতেই গুলি ছোড়ার জন্য অস্ত্র প্রস্তুত থাকা স্বত্বেও গুলি ছোড়ার, বিশেষ করে সামনে যারা ছিল, সুযোগ পায়নি।

পেছনের দিকে যারা ছিল, তাদের দুই তিন জন আমাদেরকে পাল্টা গুলির চেষ্টা করলেও কেউ দুই তিন রাউন্ডের বেশী গুলি করতে পারল না। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত খণ্ডযুদ্ধ শেষে খেয়াল করলাম কয়েকজন রাজাকার/মিলিশিয়া কেমন করে যেন পালাতে পেরেছিল।

কিছুক্ষণ পরে শত্রুর গুলি কমে এলে আমি, সেলিম, সবুজ, সারোয়ার সবাই জয় বাংলা, জয় বাংলা, গর্জন করতে করতে অস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কোথায় কে? সব শেষ। চারিদিকে পাকিস্তানিদের আহত ও নিহত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি সবার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে বললাম। স্বল্প আহত কয়েকজন পশ্চিম-পাকিস্তানিদের ধরলাম। কিন্তু দেখে বুঝতে পারলাম এগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য না। খুব সম্ভবত এরা পশ্চিম-পাকিস্তানের কোনো মিলিশিয়া দল। সেক্টার হেড-কোয়াটার এদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অনেক তথ্য বের করতে পারবে।

এখন আমাদের সবার সাথেই এক গুচ্ছ দড়ি থাকে। এই দড়ি দিয়ে এই ব্যাটাদের প্রত্যেকের হাত বাঁধলাম, তারপর একজনের কোমরের সাথে আরেকজনকে বাঁধলাম।

আমি যেহেতু ভাল পাঞ্জাবী ও পশতু ভাষা জানি, তাই তাদেরকে প্রথমে পাঞ্জাবিতে প্রশ্ন করলাম। পাঞ্জাবি বুঝে না। কিছু কিছু পশতু জানে, কিন্তু এটা সাধারণ পশতু ভাষা না, খুব সম্ভবত পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের কোনো এলাকার পশতুর কোনো আঞ্চলিক উপভাষা হবে। তাদের কথা থেকে যতটুকু বুঝতে পারলাম যে তারা এক মাস আগে পূর্ব-পাকিস্তানে এসেছে কায়মরক্ষা করার জন্য, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি অবশ্য সব কথা ঠিক মতো বুঝতে পারলাম না। অযথা সময় নষ্ট না করে এদের জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের হাতে সোপর্দ করাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

কয়েকজন রাজাকার আহত হয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিল, এদেরকে জীবিত রাখার কারণ আছে বলে মনে হলো না কেননা কিছুক্ষণ আগে এরাই আমাদেরকে হত্যা করার চেষ্টা করছিল। আমি নিজেই একজন রাজাকারকে গুলি করলাম, গেদু কাউকে কিছু করতে দিল না, সে তার ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তিন জনকে গুলি করে মেরে ফেলল। আমি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম, গেদুর চোখ দিয়ে কেমন যেন প্রচণ্ড ঘৃণার আগুন জ্বল জ্বল করছে। আমি গেদুর এই রূপ আগে দেখিনি। আরও কয়েকজন গুরুত্বর আহত ছিল কিন্তু মনে হলো না তাদেরকে কিছু করার দরকার আছে, তাদের ভবলীলা ক্ষণেই সাঙ্গ হবে। আমরা দ্রুত এলাকা ত্যাগ করলাম কেননা একটু পরেই পাকিস্তানি গোলন্দাজরা এখানে গোলাবর্ষণ শুরু করবে।

এখন প্রায় তিনটে বাজে। আমাদের সাথের চিড়া-গুড় খাওয়া হয়নি, কখন খাব? এতো উত্তেজনার মাঝে কী খাওয়া যায়? তাছাড়া আমাদের সবার মন এখন ফুরফুরে। অনেক শত্রুকে হতাহত করেছি, অনেক অস্ত্র দখল করেছি, এবং সর্বোপরি আমাদের একজনের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগানি। কাজেই আমাদের সকলেরই আনন্দে বগল বাজানর কথা।

হিসাব নিয়ে দেখলাম যে আজকে আমাদের দখলে চারটি একে-৪৭ ও আটটি চাইনিজ রাইফেল এসেছে।

বেলা প্রায় সাড়ে চারটার দিকে আমরা ক্যাম্পে ফিরলাম।

প্রথমেই আমাদের বন্দিদেরকে ক্যাপ্টেনের কাছে হস্তান্তর করে তাকে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলাম। আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি জানে খুশী হলেন। আমি পরে তাকে বিস্তারিত জানাব বললাম। আমাদের কেউ দুপুরের খাওয়া খায়নি। সেলিম ও সারোয়ার সহ সন্ধ্যায় আমরা আপনাকে বিস্তারিত বলব।

ক্যাপ্টেন বেশ চিন্তিত হয়ে বললেন, “এখন তো কোনো খাবার পাবে বলে মনে হয় না।আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “আমাদের সাথে দুপুরের খাবার চিড়া ও গুড় আছে, সেটা দিয়েই চলবে।ইতোমধ্যে সুবেদার-মেজর বশীর এসে যোগ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন সুবেদারের উদ্দেশ্যে বললাম, “বশীর সাহেব, আজকে সন্ধ্যায় এদের জন্য একটু ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা যায় না? আর এদেরকে নিয়ে নতুন যে তাঁবু লাগান হয়েছে সেখানে বেঁধে রাখেন এবং যত শীঘ্র সম্ভব সেক্টার-হেড-কোয়াটারে পাঠিয়ে দিন।

ক্যাপ্টেন থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই ছড়াতে গিয়ে গোছল করার পর আমরা ২১-জন যারা আজকের অভিযানে গিয়েছিলাম তারা সবাই গোল হয়ে বসে খুব তৃপ্তি সহকারে চিড়া/গুড় খেতে শুরু করলাম। খিধা থাকলে শুধু চিড়া ও গুড়ও যে কত সুস্বাদু হতে পারে সেটা বুঝতে পেলাম। কিন্তু খেতে ভাল লাগলেও পেট ভরল না। আমারা সবাই রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। ইতোমধ্যে সাড়ে-পাঁচটা বেজে গেছে। আজকে সূর্যাস্ত ৬:৩০ মিনিটে। এখন কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নেয়া যায়। আজকের অভিযাত্রী দলের স্ট্যান্ড-টু করতে হবে না।

আমি শুয়ে শুয়ে আজকের ঘটনা নিয়ে ভাবছিলাম। আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি গেদুর আচরণে। গেদু খুবই সাদাসিধা, শান্ত, অনেকে বলবে বোকা বা খুবই সরল প্রকৃতির। সে সব সময় একটা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে থাকে। সে কী কাজ করে বা করত তা এমই জানি না। কিন্তু আজকে যুদ্ধের সময় আমি তার যে রূপ দেখলাম সেটা দেখে মনে হয় পাকিস্তানিদের প্রতি তার প্রচণ্ড ক্ষোভ আছে। আমাদের সকলেরই ক্ষোভ আছে, কিন্তু কেন যেন মনে হয় তার ক্ষোভ বিশেষ ব্যক্তিগত।

নিজের অজান্তেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এসেছিল, “এই সোহেল ওঠ, ওঠ,” ডাক শুনে চোখ খুললাম। তাকিয়ে দেখি সারোয়ার ডাকছে। চল, খাবার দেয়া হচ্ছে, ওঠ।আমি আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠলাম।

আজকের খাবার অন্য দিনের তুলনায় বেশ উন্নত। ডাল, ভাজি, ও রুটির সাথে যোগ হয়েছে মশলা দিয়ে রান্না করা একটি বিশাল হাসের ডিম। এই ডিম সহকারে আমরা সবাই খুব তৃপ্তির সাথে রাতের খাবার খেলাম।

সাড়ে সাতটার সময় সেলিম, সারোয়ার, ও আমি ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গেলাম। আজকে কোন কারণে হ্যাজাক-লাইট লাগান হয়েছে। চারিদিকে আলো কিন্তু একই সাথে অসংখ্য পোকার উৎপাত। তাঁবুর ভিতরে ক্যাপ্টেনের সাথে আরেক জন বসে আছে। পরক্ষণেই চিনতে পারলাম, আরে এতো দেখি সেই প্রথমে দেখা লেফটেনেন্ট শামিম। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে ক্যাপ্টেন আমাদেরকে তার বিছানায় বসতে বললেন। আমরা তিনজন ক্যাপ্টেনের দিকে মুখ করে বিছানায় বসলাম।

আমি বলতে শুরু করলাম। আমি তাকে বিস্তারিত ঘটনা জানালাম। কেমন করে আমরা সেনাদলকে প্রলুব্ধ করে টেনে এনেছিলাম, কেমন করে এম্বুশ করলাম, আমাদের ছেলেদের সাহস, ইত্যাদি সবকিছু বললাম। মাঝে মাঝে কিছু কিছু সেলিম ও সারোয়ারও যোগ করল।

আমার কথা শেষ হলে ক্যাপ্টেন মন্তব্য করলেন, “খুব ভাল, কিন্তু তোমরা মনে হয় একটু বেশী ঝুঁকি নিচ্ছ। নেহায়েত ভাগ্যগুণে আজকে তোমাদের কোনো হতাহত হয়নি। আমি আশা করব তোমরা আরেকটু সতর্ক হবে।ক্যাপ্টেনের কথায় মনে হলো কেউ যেন আমাদের জ্বলন্ত উচ্ছ্বাসে শীতল পানি ঠেলে দিল। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আমাদের এই ক্যাম্প ত্যাগ করার সময় এসেছে।

ক্যাপ্টেন আবার বলতে শুরু করলেন, “শামিম সংবাদ নিয়ে এসেছে যে পরশু সকালে পাকিস্তান নিয়মিত সেনাবাহিনীর একটি প্লাটুন রেলগাড়িতে চড়ে আখাউড়া থেকে জগদীশপুর যাবে। আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইঞ্জিন সমেত সৈন্য ভর্তি রেলগাড়ি ধ্বংস করার জন্য। আমাদেরকে আগামীকাল সন্ধ্যায় অভিযানে বের হতে হবে।

আমরা তিন জন মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।

ক্যাপ্টেন আরও জানালেন যে আগামীকাল তিনি এ ব্যাপারে সবাইকে বিশদভাবে বলবেন।

আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কি মনে হয় সেলিম, এখানে আর বেশীদিন থাকা যাবে? সারোয়ার?” আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সেলিম উত্তর দিল, “নাহ! মনে হয় না। আমাদের যুদ্ধের ধরনের সাথে প্রথাগত যুদ্ধে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মিলবে না। আমাদের এখন সময় এসেছে মূল পরিকল্পনা মতো দল নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা। ভারতে আর থাকতে ভাল লাগছে না।

ঠিক আছে, কালকের অপারেশন থেকে ফিরে আমরা এ নিয়ে ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলব, ঠিক আছে?” সেলিম ও সারোয়ার সায় দিল।

রাত অনেক হয়েছে, আমরা ক্লান্ত ছিলাম ফলে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল আজকে মে মাসের ১৮ তারিখ, সরোয়ারের জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে কিছু একটা করতে হবে।

সকালের নাস্তার পর আমাদের দলের যারা অভিযানে যাবে তারা সবাই ক্যাপ্টেনের তাঁবুর সামনে জড়ো হলাম। EPR-দের অনেককে দেখলাম। আমাদের ছোট দলের নেতা হাবিলদার মাসুম, সে আমাদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন হাতে একটি সামরিক ম্যাপ সহ তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। ম্যাপটা মাটিতে বিছিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসলেন। দেখলাম ম্যাপে রঙ্গিন রঙ্গিন পেনসিল দিয়ে আঁকা অনেক কিছু।

তিনি শুরু করলেন, “এটা হচ্ছে আখাউড়া-সিলেট রেল-লাইন। একটি রেলগাড়ি এই প্লাটুন সৈন্য ও তাদের গোলাবারুদ সহ আখাউড়া থেকে জগদীশপুর যাবে। তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে এই রেলের সেনারা জগদীশপুরের সেনাদেরকে বদলাবে এবং জগদীশপুরের বর্তমান সৈন্যরা ফিরতি রেলে আখাউড়ায় ফিরে আসবে। জগদীশপুর পাকিস্তানিদের দুটি ১০৫ মিলি মিটার আর্টিলারি গান (কামান) ও দুইটি ১২০-মিলি মিটার মর্টার আছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই সদস্যরা এই কামান ও মর্টারের প্রতিরক্ষায় থাকে।

আমরা এই রেলগাড়িকে এই জায়গায় ধ্বংস করব,” ম্যাপের একটি লাল কালিতে বৃত্তাকারে দায় দেয়া একটি নির্দিষ্ট জায়গা হাতের লাঠি দিয়ে গুতা মেরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করলেন।

তারপর কারা বিস্ফোরক লাগাবে, কার কী দায়িত্ব থাকবে সে সব সবাইকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর মিটিং শেষ হলো। এখন প্রায় দশটা বাজে। মিটিং থেকে ফেরার আগে আমি আমাদের ছোট দলকে নিয়ে বাজারে যাবার অনুমতি চাইলাম এবং আজকে যে সারোয়ারের জন্মদিন সেটাও জানালাম। ক্যাপ্টেন শুধু বললেন, “বেশী দেরী করো না।

আমি আজিমপুরের সবাইকে ডাকে বললাম, “আমরা একটু বাজারে যাব কিছু কাজ আছে।আমরা ১৫-মিনিটের মধ্যে বের হব। সাথে অস্ত্র নেবার দরকার নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই সমেবেত হলে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। আমরা সবাই সেই বড় চায়ের দোকানে বসলাম। এখন দোকানে বসার জায়গা বাড়িয়েছে ফলে সবার বসতে অসুবিধা হলো না। আমি দোকানীকে সকলকে চারটি করে রসগোল্লা, দুটি নিমকি, ও একটা কচুরি দিতে বললাম। আমার মনে হয় কয়েকজন ঘটনা বুঝতে পেরেছিল কিন্তু কিছু বলল না।

খাবার পরিবেশন করা হলে আমি চিৎকার করে বললাম, “কি মিয়াঁরা, আজকে যে সারোয়ারের জন্মদিন সেটা কী সবাই ভুলে গেছ?” আসলে অনেকেরই মনে ছিল কেননা আমারা সবাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার সবাই এক সাথে ইংরেজিতে শুভ জন্মদিন সারোয়ার বলে চিৎকারে দোকান ফাটিয়ে ফেললাম। আমরা সবাই সারোয়ারের সাথে কোলাকুলি করলাম। সে এক খুবই আনন্দঘন পরিবেশ।

 ক্যাম্পে ফিরে দেখি দুপুরের খাবার দেয়া হচ্ছে। আমরাও সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগের মিষ্টি ও নিমকি মনে হয় আমাদের খিদে আরও বাড়িয়ে দিল। খাওয়া শেষে আমরা সবাই যার যার তাঁবুতে ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আজকে রাতে ঘুম নেই।

একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, ১৯৭১-সালে যখনি ঘুমাতে চেয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে পেরেছি।

আজকে অবশ্য রাতের খাবার শেষেই যাত্রা, কোনো চিড়া গুড় নেবার প্রয়োজন নেই। আমরা সবাই প্রায় প্রস্তুত হয়েই খাবার লাইনে দাঁড়ালাম।

সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটা প্রায় হয়ে এলো, ক্যাপ্টেনের তাঁবুর সামনে আমরা  সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। ক্যাপ্টেন তাঁবু থেকে বেরিয়ে সবাই কে উদ্দেশ্য করে একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিলেন। এখন মোটামুটি তার এই বক্তৃতা প্রায় গথ বাঁধা, আগের মতো উজ্জীবিত করে না। তার কথা শেষ হলে আমরা সবাই সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দিকে যাত্রা করলাম। আমদের দলে সর্বমোট ৫০-জনের মতো।

রাস্তায় দুটো ট্র্যাক পার্ক করা ছিল। আমরা সবাই ট্রাকে উঠলে ট্র্যাক চলতে শুরু করল।

এখন সন্ধ্যা, কিন্তু এই আলো-বিহীন নির্জন প্রান্তরে সন্ধ্যা ও রাতের বিশেষ পার্থক্য নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে কালো। আমাদের ট্র্যাক দুটো মনে হচ্ছে অন্ধকার খুড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হয় অন্ধকারটাই আদি ও অকৃত্রিম রূপ। আলো অপ্রকৃত, আলো অন্ধকারকে ক্ষণিকের জন্য দূর করতে পারলেও অন্ধকার আবার সবকিছু গ্রাস করে নেয় যেমন এই ট্র্যাক যেই অন্ধকার ভেদ করে এসেছে সেটা আবার অন্ধকারেই হারিয়ে গেছে। সারোয়ারের কথায় চিন্তার ছেদ পড়ল, “নে, সিগারেট নে,” সারোয়ার আমাকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিলে আমি সিগারেট নিয়ে জ্বালালাম। কোনো কথা না বলে আমরা দুজন নীরবে সিগারেট টানতে লাগলাম।

প্রায় দেড়-ঘণ্টা পর ট্র্যাক থামলে আমরা সবাই নামলাম। এখানে আমরা রেকির সময় এসেছিলাম, কিন্তু এই অন্ধকারে কিছুই চিনতে পারছি না। কিছুক্ষণ সময় লাগল অন্ধকারে নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। এখন বুঝতে পারছি, ঐ তো সেই ছোট রাস্তা যেটা সীমান্তের দিকে গিয়েছে।

ক্যাপ্টেন রানা সামনে, সাথে একজন গাইড়। আমরা সবাই তার পেছনে এক লাইন করে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমারা তুলশীপুর সীমান্তে পৌঁছলাম। ক্যাপ্টেন সবাইকে নির্দেশ দিলেন যে এখন আর সিগারেট খাওয়া যাবে না।

এই সীমান্ত থেকে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। আমরা নিঃশব্দে অন্ধকারে হাঁটছি, হাতের অস্ত্র প্রস্তুত। যদিও কোনো ঝঞ্ঝাট কাঙ্ক্ষিত না হলেও যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা ভাল।

প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর সেই রেকি করার সময় দেখা কুটিরগুলোতে পৌঁছলাম। এখান থেকেই সবাই তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানে যাবে।

প্রথমে রেললাইনের উভয় পাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য দশ জনের দুটি দল চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমদের পাঁচটি দল রেললাইনের দিকে অগ্রসর হলাম। রেললাইনে পৌঁছতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগল।

প্রথমেই আমি ও হাবিলদার মাসুম আমাদের সাথে নিয়ে আসা দড়ি দিয়ে কোন দল কোথায় বিস্ফোরক লাগাবে সেটা নির্ধারণ করলাম। সবাই রেললাইনের উপরে তাদের নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়ল।

প্রথমেই যেখানে বিস্ফোরক লাগান হবে সেখান থেকে সব পাথর সরিয়ে রাখা হলো। তারপর গর্ত খুঁড়তে শুরু করলাম। অনেক বার অনুশীলন করার ফলে গর্ত সহজেই খুঁড়তে পাড়লাম। তাছাড়া আমার দলের আলীকে খোঁড়াখুঁড়িতে বিশেষ পারঙ্গম মনে হলো। গর্ত খোঁড়া শেষে সাথে বাঁশের খাঁচায় নিয়ে আসা পূর্বনির্ধারিত ওজনের বিস্ফোরক সেই গর্তে ঢুকান হলো। এখন হাবিলদার মাসুমের কাজ সব চারটি বিস্ফোরক চার্জকে এক্সপ্লোসিভ-কর্ড দিয়ে সংযোগ দেয়া যেন প্রথম চার্জ বিস্ফোরণের সাথে সাথে সবগুলো একসাথে বিস্ফোরিত হয়। কাজটা খুব কঠিন না, কঠিন হচ্ছে এই উজ্জ্বল হলুদ রঙের এক্সপ্লোসিভ-কর্ডকে রেললাইনের নীচে লুকিয়ে রাখা।

হাবিলদার মাসুমের কাজ শেষ হলে আমরা গর্তগুলো আবার ভরতে শুরু করলাম। অতিরিক্ত সব মাটি সাথে নিয়ে আসা চটের বস্তায় ভরে ফেলা হলো যেন রেললাইনে খোঁড়ার কোন চিহ্ন না থাকে। সব শেষে উপরের পাথরের টুকরাগুলোকে আবার পরিপাটি করে বিছিয়ে দেয়া হলো। কাজ মোটামুটি শেষ, এখন শুধু দেখতে হবে কোথায় কোনো ফাঁকফোকর রয়ে গেল কি না।

ক্যাপ্টেন রানা টর্চ-লাইট নিয়ে রেললাইন নিজেই পরীক্ষা করলেন। নাহ্‌, বোঝার কোনো বোঝার উপায় নেই। পরিদর্শন শেষে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন।

আজকের এই বিস্ফোরণ ঘটান হবে বিদ্যুতের মাধ্যমে। একটি তার

মাসুমের লাগান বিস্ফোরক থেকে আমাদের সেই কুটির পর্যন্ত টানতে হবে। তারের এক মাথা বিস্ফোরকের ডেটোনেটরে ও অন্য মাথা প্লাঞ্জারে (plunger) লাগান থাকবে। (প্লাঞ্জার আসলে একটি ছোট বৈদ্যুতিক জেনারেটর।)

তার টানতে বেশী সময় না লাগলেও তারটাকে লুকাতে অনেক ঝামেলা হলো। অবশেষ আমাদের কাজ শেষ হলো।

আমরা সবাই আবার কুটিরে ফিরে এলাম। এখন এখানে আর এত লোক থাকার দরকার নেই। একমাত্র কয়েকজন ছাড়া বাকী সবাইকে ক্যাপ্টেন সীমান্তের দিকে পাঠিয়ে দিলেন।

শুধু রইল ক্যাপ্টেন, মাসুম, সেলিম, সারোয়ার, সবুজ, ও আমি। এখন অবশ্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কাজ নেই। খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু খাওয়া যাবে না।

এতক্ষণ ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করিনি। কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আমাদের আক্রমণ শুরু করল। মশার কামড়ে আমরা সবাই নাস্তানাবুদ। আমি গামছা দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢাকলাম, যদি একটু কামড় থেকে বাচা যায়। এখন রাত তিনটে। সূর্যোদয় ৫:১৫ মিনিটে।

আমাদের কাজ এখনো কিছু বাকী। আমাদের থেকে বিস্ফোরণের দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ। যেই পরিমাণ বিস্ফোরক আমরা লাগিয়েছি, এত কাছ থেকে তার ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে বাচতে হলে ফক্সহোলের ভিতরে আশ্রয় নিতে হবে। কাজেই আমরা সবাই ফক্সহোল খুঁড়তে মন দিলাম। মশার কামড় খাওয়া থেকে গর্ত খোঁড়া অনেক ভাল। দুই ঘণ্টায় মধ্যেই ফক্সহোল খোঁড়া শেষ। মশা থেকে বাঁচার জন্য আমি ফক্সহোল ভিতর ঢুকে মাথা গামছা দিয়ে ঢাকলাম। এবার মনে হয় একটু পরিত্রাণ পেলাম।

কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে পূর্বের আকাশ ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মশারাও তাদের নৈশ আক্রমণের সমাপ্তি ঘোষণা করল।

আমি রেললাইনের দিকে উকি দিলাম। শুধু পাখির কিচিরমিচির ছাড়া চারিদিক সুনসান। দেখলাম হাবিলদার মাসুম তার জিনিষ ঠিক ঠাক করছে। ট্রেনের সকালে আসার কথা, কিন্তু ঠিক সকাল কয়টায় তা জানি না।

এভাবে প্রায় আধা-ঘণ্টা বসে থাকার পর দুই জন খাকী পোশাক পরা লোককে রেললাইনে দেখতে পেলাম। দুজনের হাতে মাইন-ডিটেক্টর। তারা দুজন রেললাইনে মাইন লাগান আছে কি না নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। আমার আমাদের যেহেতু বিস্ফোরক তৈরিতে কোনো ধরনের ধাতব পদার্থ ব্যবহার করিনি, ফলে মাইন-ডিটেক্টর দিয়ে আমাদের বিস্ফোরক বের করা যাবে না। কিছুক্ষণ পরে শুনলাম তারা দুজন গান গাইতে গাইতে আসছে। তারা কোরাস গাইছে, “নাদিয়া কে বিচ গোরি হালচাল মাচায়ে রে।।গলা খুব একটা খারাপ না। আবার মাঝে মাঝে গানের তালে তালে শরীরটাকে কেমন যেন বিচিত্র ভাবে নড়াচ্ছে। মনের শুখে তারা দুইজন আমাদের সামনে দিয়ে কানে হেড-ফোন লাগান, মাইন ডিটেক্টর হাতে গান গাইতে গাইতে ও নাচতে নাচতে চলে গেল। কাছে আসলে বুঝতে পারলাম এরা দুজন পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর সদস্য।

মাছ শিকারের সময় যেরকম বড়শীতে টোপ ঝুলিয়ে মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আমাদেরও প্রায় সেই অবস্থা। কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে রেলের ইঞ্জিনের হুইসল শুনতে পেলাম। আমরা সবাই নড়ে চড়ে বসলাম।

আমাদের বাম দিক থেকে এই রেলগাড়ি আসছে, ইঞ্জিন ও চারটি বগি।

চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ্য করলাম মাসুম প্লাঞ্জারে তার লাগিয়ে প্লাঞ্জার টেপার জন্য টানটান হয়ে আছে। এবার কেমন যেন সময় থেমে গেল। স্লো-মোশন সিনেমার মতো সামনে ভেসে এলো রেলের ইঞ্জিন, তারপর বগিগুলো, বগির ভিতরের মানুষের মুখগুলো যারা ক্ষণেই অপর পাড়ের যাত্রী হতে যাচ্ছে। মাসুম প্লাঞ্জারে চাপ দিল।

আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল যে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী বিস্ফোরক ব্যবহার করছি, তা না হলে এত বড় বিস্ফোরণ হতে পারে না। ভাগ্য ভাল যে আমরা সবাই, শুধু মাসুম ছাড়া, দুই কান আঙ্গুল ঢুকিয়ে বন্ধ করেছিলাম, তা না হলে সবার কানের পর্দা ফেটে যেত। বিস্ফোরণের পর সম্পূর্ণ ট্রেন-ইঞ্জিন ও চার বগি,--মুহূর্তে কিছুক্ষণ শূন্যে ভেসে রইল তারপর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা যেই কুটিরকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করছিলাম, বিস্ফোরণের প্রচণ্ড তোড়ে কয়েকটা কুটির কালবৈশাখী ঝড় যেমন সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ফেলে, এই বিস্ফোরণের ফল তাই হলো। একটা বগি, আসলে বগি না বলে বলা উচিৎ বগির লোহার চাকা ও এক্সাল, দুমড়ে মুচকে আমাদের ফক্সহোল থেকে প্রায় ২০-গজ দূরে ধপাস করে পড়ল।

রেলগাড়ির কিছু অবশিষ্ট নেই। চারিদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আহত বা নিহত হয়ে পড়ে আছে। চারিদিকে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছেএক বীভৎস দৃশ্য।

কিন্তু বিস্ফোরণের তেজ এত তীব্র হওয়ায় আমাদের মাথায় পাথর বা অন্য কিছুর পড়ার যে আশংকা করেছিলাম সেটা হলো না। সব পাথর ও রেললাইনের টুকরা আমাদের থেকে অনেক দূরে পড়ল।

আমরা কিছুক্ষণ পরে যখন যায়গাটা ত্যাগ করলাম তখন দেখে মনে হচ্ছিল এটা কোনো মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাঙ্গারি বা scrape yard.

শুধু মাসুম বিস্ফোরণের পর সহজে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। 

 আমরা যখন প্রায় সীমান্তের কাছাকাছি, তখন পাকিস্তানিদের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। আমরা তখন তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আজিমপুরের দুর্দান্ত যোদ্ধারা, চতুর্থ পর্ব

ধর্মান্ধতা কী?