আজিমপুরের দুর্দান্ত যোদ্ধারা, চতুর্থ পর্ব
সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ ফুরফুরে লাগল। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে, ফলে গত দুদিনের ক্লান্তি অনেকটা কেটে গেছে।
গত রাতে ঘুমানোর
আগে ভাবছিলাম আমাদের সদ্য দখল করা পিস্তলটা যেটা ক্যাপ্টেন
রানা নিতে চাননি সেটা কী করা যায়? এ পিস্তলটা সবার কাছেই লোভনীয়। আমারও
খুব লোভ হচ্ছিল পিস্তলটা নিজে রাখার। কিন্তু আমি দলনেতা, ইতোমধ্যে একটি
একে-৪৭ নিয়েছি, এখন যদি আবার পিস্তলটাও
দখল করি তাহলে সেটা ভাল দেখায় না। কাজেই চিন্তা করতে শুরু করলাম পিস্তলটা কাকে
দেয়া যায়।
জিপে আক্রমণের সময় সবচেয়ে বীরত্ব কে
দেখিয়েছিল? নিঃসন্দেহে সে ছিল কবীর।
কবীর পরিখা থেকে ঊঠে জিপকে আক্রমণ করার পরই অন্যরা তাকে অনুসরণ করি। সে জন্য মনে
হলো যে পিস্তলটা কবীরকেই দেয়া উচিৎ। কবীরকে একটা একে-৪৭ দেয়া যেত, কিন্তু তার প্রধান অস্ত্র লাইট-মেশিনগান, ফলে তার পক্ষে একে-৪৭ ব্যবহার করা সম্ভব না।
সকালের নাস্তা
শেষ হলে আমি তাঁবুতে সবাইকে গোল হয়ে বসতে বললাম। সবাই বসলে আমি বলতে শুরু করলাম, “আমাদের গত অভিযান খুবই নিপুণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এবং আমাদের দলের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে
পেরেছি। সে জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। এই অপারেশনে আমাদের কার্যক্রম দেখে ক্যাপ্টেন রানা সহ
কোম্পানির সবার আমাদের প্রতি বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়েছে ও আমরা যে নির্ভরযোগ্য সেটা
আমরা প্রমাণ করেছি। আমরা প্রমাণ করেছি যে ছাত্র হলেও আমরা কোন অংশে পেশাজীবী
সৈন্যদের তুলনায় কম না। তবে এই ঘটনার পরে আমাদের অবশ্যই অর্জিত ওজন ধরে রাখতে হবে।
এটা ছিল আমাদের প্রথম অপারেশন, ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক অভিযান হবে, আমি আশা করব সেখানেও আমারা আজিমপুরের যোদ্ধারা গত দিনের মতো
আজিমপুরের সম্মান রক্ষা করব।
এখন কিন্তু
আমাদের দল শুধু ১৪-জনের না। আমাদের আরও ৩৬-জন সহযোদ্ধা আছে। তারাও আমাদের মতো
দেশের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছে। কাজেই তাদেরকে অবহেলা করা যাবে না। তাদেরকেও আমাদের
মতো করে গড়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে আমাদের শিখাতে হবে, তাদের সাথে আমাদের সবার সখ্যতা গড়ে তুলতে হবে এবং নেতৃত্ব
দিতে হবে। তাদের অনেককেই কিন্তু আমার সাহসী মনে হয়েছে। সেজন্য আমার সবার কাছে
অনুরোধ তাদেরকে আমাদের সাথে সংহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
আমার মনে হয় শুধু
তাদের না, আমাদের নিজেদের আরও
প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। যেমন বিস্ফোরক সম্পর্কে এখনও আমাদের ভাসা ভাসা জ্ঞান। এত
অল্প জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে কাজ করতে পারব না। আমি
ক্যাপ্টেন রানা কে অনুরোধ করব হাবিলদার মাসুম যেন আমাদেরকে বিস্ফোরক সম্পর্কে বিশদ
ট্রেনিং দেয়।
আরেকটা জিনিস
আমার মনে হয়েছে। আমাদের যুদ্ধের মূল কৌশল গেরিলা পদ্ধতি হলেও
প্রথাগত যুদ্ধের কিছু কৌশল শিখতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক শত্রু আমাদেরকে
মেশিনগান দিয়ে গুলি করছে এবং আমাদের এই মেশিনগানকে ধ্বংস করতে হবে। কী উপায়ে করব? আমরা কেউ জানি না, তাই না? কাজেই এটা অবশ্যই আমাদের শুধু জানলে হবে না প্রশিক্ষণ করতে
হবে যেন প্রয়োজনে সহজেই কাজটা করতে পারি।
আরেকটা উদাহরণ
দেই। লাইট-মেশিনগান দিয়ে গুলি করা। ধরা যাক এক লাইনে ১০-১২ জন শত্রু আমাদেরকে
আক্রমণ করতে আসছে। এই পরিস্থিতিতে লাইট-মেশিনগান দিয়ে শত্রুকে কোন দিক থেকে আক্রমণ
করা উচিৎ? সামনে থেকে, দুই পাঁশ থেকে, না অন্য কোথাও থেকে? কেউ বলতে পারবে? আমিও ঠিক জানি না। কিন্তু
একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মনে হয় সম্ভবত সামনে থেকে না।
আমার মূল বক্তব্য, আমাদের যুদ্ধের অনেক কলাকৌশল এখনও অজানা, এবং আমাদের সবাইকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্ত অজানা জিনিস
জানতে হবে ও রপ্ত করতে হবে। আমাদের এই যুদ্ধে সফল হতে গেলে এর কোন বিকল্প নেই।
আমার বক্তব্য
প্রায় শেষ, শুধু একটি বিষয় বাকী আছে।
তোমরা সবাই জানো যে গত অপারেশনে আমরা তিনটি একে-৪৭ রাইফেল, তিনটি চাইনিজ রাইফেল,
একটি চাইনিজ
পিস্তল, ও একটি স্মিথ এন্ড অয়েসন
.৩৮ রিভলভার দখল করেছি।
তিনটে একে-৪৭-এর
মধ্যে একটি আমি নিয়েছি, একটি সেলিম নিয়েছে, তৃতীয়টি এখনও কাউকে দেয়া হয়নি। চাইনিজ রাইফেলগুলো এখন আমার
কাছে আছে, কেউ যদি এই চাইনিজ রাইফেল
চাও তাহলে আমাকে জানাবে। একে-৪৭ আমরা পরে ঠিক করব সেটা কে পাবে। রিভলভারটা আমার কাছে
আছে। চাইনিজ পিস্তলটা আমি ক্যাপ্টেন রানাকে দিতে চেয়েছিলাম এবং তাকে দেবার জন্য
গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন যে ওটা তোমরা দখল করেছ, কাজেই তোমরা রাখ। এই বলে তিনি পিস্তলটা ফেরত দিয়েছেন।
পিস্তলটা এখন
আমার কাছে আছে। আমি পিস্তলটা গত অপারেশনে যে সবচেয়ে বেশী বীরত্ব দেখিয়েছে, আমাদের কবীরকে দিতে চাই। তোমরা কী বল?”
আমার কথা শুনে
সবাই চিৎকার করে ও হাততালি দিয়ে কবীরকে অভিনন্দন জানাল। আমি চামড়ার খাপ সহ চাইনিজ
৭.৬২ পিস্তলটা কবীরকে দিলাম। সবাই কবীরকে আবার হাততালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল।
আমাদের মিটিং
এখানেই শেষ হলো।
আমি আবার
ক্যাপ্টেন রানার কাছে গেলাম। তার সাথে আমাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ
করলাম। তিনি আমার সাথে একমত হয়ে বললেন, “কবীর, তুমি কি সবসময় এইসব নিয়ে চিন্তা করো? তোমাকে দেখি সবসময় কিছু না কিছু ভাবছ অথবা পরিকল্পনা করছ।
আমার দলে তোমার মতো আরও কয়েকজন থাকলে ভাল হতো। ঠিক আছে, আমি মাসুমকে বলছি তোমাদেরকে বিস্ফোরক বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা করতে। আর কেমন করে মেশিনগান নিষ্ক্রিয় করতে হয়, কেমন করে কোথায় মেশিনগান বা লাইট-মেশিনগান লাগাতে হয়, কোথা থেকে গুলি করলে সবচেয়ে ভাল হয়, ইত্যাদি আমি নিজেই তোমাদেরকে শেখাব। আমার মনে হয় আমার দলের EPR-দেরকেও এটা শেখানো উচিৎ। ঠিক আছে, আমি পরে তোমাকে জানাব।“
কথা শেষ হলে আমি
তাঁবুতে ফিরে এলাম।
আজকে আমাদের কাজ
ছিল না। আমাদের ক্যাম্পে থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে একটি গ্রাম্য বাজার আছে বলে
শুনেছি। বাজারে সপ্তাহে একদিন হাট বসে যখন অনেক ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়।
সপ্তাহের অন্য দিন খোলা থাকলেও বাজারে লোক খুবই কম থাকে। যেহেতু বাজারটা এখনও
আমাদের দেখা হয়নি, তাই ঠিক করলাম আমরা সবাই
আজকে বাজার দেখতে যাব।
আমাদের কাছে এখনও
ঢাকা থেকে নিয়ে আসা অনেক টাকা রয়ে গেছে। আমাদের এখনকার খরচ হয় সিগারেট, মাঝে মাঝে কলা বা বিস্কুট, ইত্যাদিতে। কাজেই
টাকা খরচ করার সুযোগ বিশেষ নেই।
আমি আমার
প্লাটুনের সবাইকে বললাম। সবাই যেতে চাইল। আমি সবাইকে প্রস্তুত হতে বললাম। বলে দিলাম কোনো অস্ত্র সাথে
নেবার দরকার নেই।
ক্যাম্প থেকে বের
হবার আগে ক্যাপ্টেনকে জানাতে গেলাম। তিনি শুনে বললেন, “তোমরা আগে কখনো গিয়েছ?”
আমার ‘না’ উত্তর শুনে তিনি বললেন, “দাড়াও, আমি তোমাদের সাথে
হাবিলদার শহীদকে দিচ্ছি, তার সাথে স্থানীয় BSF-এর (Border Security
Force, বা ভারতীয়
সীমান্ত প্রহরী)ভাল সম্পর্কে আছে। এখানকার BSF-দের সাথে তোমাদের যেহেতু
এখনো পরিচয় হয়নি তাই তোমাদেরকে দেখলে তোমাদের পরিচয় জানতে চাইবে। শহীদ তোমাদের
সাথে থাকলে কোনো ঝামেলা হবে না।“ আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে
তাঁবুতে ফিরে হাবিলদার শহীদের অপেক্ষায় রইলাম।
এক ফাঁকে রহিমকে
(আমাদের কোষাধ্যক্ষ) ডেকে বাজারে সবার যা খরচ হবে সেটা আমাদের কমন ফান্ড থেকে
পরিশোধ করতে বললাম। কেননা আমার মনে হচ্ছিল আমাদের বৃহৎ দলের অনেকেরই হয়ত সাথে
বিশেষ টাকা-পয়সা নেই।
কিছুক্ষণ পরে হাবিলদার
শহীদ এলে আমরা সবাই বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ঘড়িতে দেখলাম সকাল আটটা বাজে।
আমাদের বর্তমান
ক্যাম্পের বর্ণনা এখনো দেয়া হয়নি। ভারতের এই এলাকার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট ঢিবি বা টিলা ও কিছু সমতল ভূমি আমাদের
ক্যাম্পটা এরকমেরই একটি টিলার উপরে। এখানে মোট
১৮টা তাঁবু। ক্যাপ্টেন রানা ও সুবেদার-মেজরের জন্য স্বতন্ত্র তাঁবু, সুবেদার ও নায়েব-সুবেদার দুইজন করে এক তাঁবুতে, বাকীরা (হাবিলদার, নায়েক, ল্যান্স-নায়েক, ও সিপাইরা বড় তাঁবুতে
থাকে। তাছাড়া, মালামাল, বিশেষ করে খাবার জিনিস রাখার জন্য একটি তাঁবু, অস্ত্র ও গোলাগুলি রাখার তাঁবু, চিকিৎসার জন্য একটি তাঁবু, আমাদের ক্যাম্প
থেকে একটু দূরে আরেকটি তাঁবু আছে যেখানে বিস্ফোরক ও মর্টারের গোলা রাখা হয়। তাছাড়া
রান্নার জন্য ত্রিপলের ছাউনি-যুক্ত একটা জায়গা আছে।
ক্যাম্পের
চারিদিকে পরিখা আছে, সকালে ও সন্ধ্যায়
স্ট্যান্ড-টু-র সময় আমরা সবাই এই পরিখায় শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় থাকি, এটা প্রাত্যহিক রুটিন। পরিখায় দুটি মেশিনগান লাগানোর জায়গা
আছে, ২৪-ঘণ্টা পালাক্রমে আটজন
সশস্ত্র লোক ক্যাম্পের চারিদিকে পাহারায় থাকে। রাতে কেউ ক্যাম্পে প্রবেশ করতে চাইলে
পাসওয়ার্ড বলতে হয়। পাসওয়ারর্ডের প্রত্যেক দিন
পরিবর্তন হয়।
আমাদের ক্যাম্পের
দুইদিকে ধানক্ষেত, পেছনে জঙ্গল ও আরও কয়েকটি
টিলা, বাম দিকটা বেশ উঁচু, গাছ-গাছালিতে ভরা। এদিক দিয়ে একটা মাটির রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
আমাদের ক্যাম্পের ব্যাবহারের জন্য একটা জিপ আছে। আমাদের তৈরি করা এই রাস্তা দিয়ে জিপ বড় রাস্তায় যেতে পারে। এই বড় রাস্তাই এখানকার মূল যোগাযোগ মাধ্যম।
এই হলো আমাদের
বর্তমান ক্যাম্পের বিবরণ।
আমরা ক্যাম্পের
টিলা থেকে ধানক্ষেতে নামলাম। এখন ধানক্ষেত নতুন ধানে সবুজ হয়ে আছে। আমরা ক্ষেতের আইল
দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাটার পরে একটি বড় কিন্তু ইটের তৈরি রাস্তায় উঠলাম। বুঝা গেল
যে এই রাস্তাই এখানকার প্রধান বা মূল রাস্তা এবং যান্ত্রিক গাড়ি এই রাস্তায় চলাচল করে।
রাস্তা দিয়ে আরও
মিনিট দশেক হাটার পর আমারা হাতের বামে একটি ছোট বাজার দেখতে পেলাম। গ্রাম্য বাজার, আজকে যেহেতু হাটের দিন না সেজন্য লোক সমাগম খুবই কম, বাজার প্রায় খালি। আমরা সবাই বাজারে ঢুকলাম।
প্রথমে ছোট বাজারটি ঘুরে দেখলাম। বাজারে আছে দুটি চা-বিস্কুট খাবার
দোকান, দুটি পান-বিড়ির দোকান, দুটি মুদির দোকান, একটি ঔষধের দোকান, একটি চুল-দাড়ি কাটার দোকান, একটি জামা কাপড়ের
দোকান, একটি কামারের দোকান, একটি দর্জির দোকান, একটি মুচির দোকান কিন্তু
এখন বন্ধ, একটি হাড়ি-পাতিলের দোকান, একটি মাটির বিভিন্ন জিনিসের দোকান, কিছু খালি মাচা যেগুলো সম্ভবত হাটের দিনে বহিরাগত
বিক্রেতারা ব্যবহার করে। কয়েকটা কুকুর বাজারে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুব বিরক্তি
সহকারে বসে আছে। আমাদেরকে দেখে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাল না, বরং একটু অন্যমনস্ক ভাবে লেজ নাড়াল। তারপর আবার নিরুদ্বেগে
বসেই রইল। তাদের দেখে মনে হলো বাজার
যেমন ঝিমাচ্ছে, তারাও বাজারের মতো ঝিমাচ্ছে।
বাজার দেখা শেষ
হলে সবচেয়ে বড় চা-বিস্কুট খাবার দোকানের সামনে সবাই সমবেত হলাম। দোকানে অবশ্য
আমাদের সবার বসার জায়গা নেই। ভিতরে দুটি বেঞ্চ ছিল যেটাতে ঠাঁসাঠাসি করে দশ জনের
মতো বসা যায়। দোকানের সামনে একটা বাঁশের মাচা যেখানে সামনে পিছনে চাপাচাপি করে আরও
দশ জন বসতে পারে। বাকী সকলকে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হলো।
হাবিলদার শহীদের
সাথে দোকানদারের ভাল সখ্যতা আছে। তাছাড়া এতজন খদ্দের পেয়ে দোকানদারও বেশ খুশী।
কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের সবাইকে একসাথে পরিবেশন করার মতো কাপ-পেয়ালা দোকানে নেই।
কাজেই যাই খাই, পালা করে খেতে হবে।
দোকানে চা ও
বিস্কুট ছাড়া সামান্য কিছু রসগোল্লা ও নিমকি দেখতে পেলাম, কিন্তু আমাদের সবার জন্য যথেষ্ট না। কাজেই আমি সবার জন্য চা
ও বিস্কুটের অর্ডার দিলাম। দোকানি জানাল যে আগের দিন বলে রাখলে সে আমাদের সবার
জন্য ব্যবস্থা করতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে
চা-বিস্কুট এলে আমি প্রথমে যারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে দিতে বললাম। আমরা যারা
ভিতরে আরাম করে বসে আছি তারা পরে খেলেও অসুবিধা নেই। যাই হোক, একসময় সবার খাওয়া শেষ হলো। আমি সবাইকে বললাম যে একঘণ্টা পরে
আমারা সবাই আবার এই চা-দোকানের সামনে মিলিত হব এবং একসাথে ক্যাম্পে ফিরব। সবাই যে
যার মতো বাজারে ঘুরতে চলে গেল।
আমি দর্জির
দোকানে গেলাম। একটা মাত্র সেলাই মেশিন। বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘর ও ছনের ছাদ। দেয়ালে
টাঙ্গানো দড়িতে কিছু সেলাই করা কাপড় ঝুলছে,
একদিকের দেয়ালে
হিন্দু দেব দেবীর ফ্রেমে বাঁধা ছবি, ছবিতে ফুলের মালা ঝোলান। দোকানে ধুপের তীব্র গন্ধ। একজন পৌড় লোক মেশিনের
পেছনে চেয়ারে বসে আছে। দোকানে আর বসার জায়গা নেই। আমার দেখে মনে পড়ল যে আমরা যে
খাকী পোশাক পেয়েছি সেটা অনেকেরই শরীরের মাপের তুলনায় অনেক বড়। বিশেষ করে সেলিমের।
সেলিমকে এই পোষাকে এমন কিম্ভুতকিমাকার লাগে যে না হেঁসে থাকা যায় না। কিন্তু
সেলিমের মেজাজের জন্য কেউ সেলিমের সামনে হাসতে সাহস করে না। সেলিম আমার সাথেই ছিল, আমি সেলিমকে তার কাপড় এখান থেকে অলটার করিয়ে নিতে বললাম।
আমার কাপড়ও সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। ঠিক করলাম পরে একসময় এখান থেকে কাপড় অলটার
করিয়ে নিব।
এখানে দেখার মতো
অন্য কিছু নেই, তাই আবার সেই
চা-বিস্কুটের দোকানের সামনে এলাম। এখনো কেউ আসেনি দেখে দোকানের ভিতরে বসে আমি ও
সেলিম চায়ের অর্ডার দিলাম। চা মনে হয় চুলায় চড়ান ছিল ফলে প্রায় সাথে সাথেই গরম গরম
চা এলো। আগের বার তাড়াতাড়ি করে চা খেতে গিয়ে চায়ের আসল স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ
হয়নি। অনেক গোরুর দুধ মেশানো চা, চা অনেকক্ষণ ফোটানোর ফলে
কেমন যেন একটা কষা কষা ভাব, একটু তিতা মতো। অবশ্য
খেতে খারাপ না। আমাদের ক্যাম্পে যে চা পাই তাঁতে দুধ থেকে না, শুধু চায়ের লিকার। গরম চা অনেকক্ষণ ধরে খেলাম। চা-খাওয়া শেষ
হবার প্রায় সাথে সাথেই অনেককে দোকানের সামনে জড় হতে দেখলাম। সবাই এলে, আমরা একসাথে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
হাটতে হাটতে
আমাদের দলের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভাবছিলাম। এখন আমাদের ৪০-জনের কাছে মোট ১৯-টা SLR রাইফেল, ১২-টা স্টারলিং
সাব-মেশিনগান, ৪-টা ৩০৩ রাইফেল, ২-টা একে-৪৭, ও চারটি ৭.৬২X৫১mm ভারতীয় লাইট-মেশিনগান (LMG) আছে। আমার মনে হচ্ছিল স্টারলিং-এর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায়
অনেক বেশী। এই ৯mm স্টারলিং
সাব-মেশিনগান খুব
কাছে থেকে যুদ্ধের জন্য উপযোগী। কিন্তু আমরা গেরিলা যোদ্ধা, কাজেই আমাদের বেশিরভাগ আক্রমণ দূরে থেকে করতে হবে। সে জন্য
এই সাব-মেশিনগান আমাদের যুদ্ধের ধরনের জন্য বিশেষ উপযোগী না। আমাদের জন্য SLR রাইফেল অনেক বেশী উপযোগী। তাছাড়া, আমাদের মতো নতুন যোদ্ধাদের প্রবণতা হচ্ছে ট্রিগার চেপে ধরে
থাকা। স্টারলিং দিয়ে যদি ক্রমাগত স্বয়ংক্রিয় (automatic)
গুলি ছোড়া হয়
তাহলে আমাদের কাছে যে তিনটে ম্যাগাজিন থাকে সেটা শেষ হতে মাত্র ২০-সেকেন্ড সময়
লাগবে (স্টারলিং থেকে স্বয়ংক্রিয় গুলি করলে, এক মিনিটে ৫০০ গুলি ছোড়া
যায়। তিনটি ম্যাগাজিনের সর্বমোট ৯৬-টি গুলি থাকে)।
এটা নিয়ে
ক্যাপ্টেন রানার সাথে পরামর্ষ করা দরকার। তাছাড়া আমাদের যে ৪-টি ৩০৩ রাইফেল আছে
সেগুলোও বদলিয়ে SLR রাইফেল নেয়া উচিৎ। আমি
উপলব্ধি করলাম যে আসলে আমাদের শিখার এখনও অনেক বাকী। সঠিক ভাবে যুদ্ধ করতে হলে আরও
অনেক কিছু জানতে হবে।
এই ভাবে কখন যে
ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম বুঝলাম না।
এখন প্রায় বেলা
বারোটা বাজে। একটু পরেই দুপরের খাওয়া পরিবেশন করা হবে। কাজেই তাড়াতাড়ি ছড়াতে গিয়ে
গোছল করে খাবার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম।
তাঁবুতে ফিরে সিগারেট
খেতে খেতে আবার চিন্তায় ডুবে গেলাম। আমরা আজিমপুরের ১২-জন যে আলাদা একটা তাঁবুতে
থাকি সেটা কী ঠিক হচ্ছে? আমার মনে হলো এটা আমাদের
ঠিক হচ্ছে না। এখন আমরা শুধু ১৪-জনের দল না,
আমাদের দলে আরও
৩৬-জন আছে।
আমাদের সবাইকে
ইতোমধ্যে চারটি সেকশনে ভাগ করা হয়েছে, কাজেই প্রতি সেকশনের নিজ
নিজ সদস্যদের একসাথে থাকা, খাওয়া, গল্প, আড্ডা, ইত্যাদি করা উচিৎ যাতে সবার মধ্যে একটি বন্ধুত্বের বন্ধন
গড়ে ওঠে। এটা করতে না পারলে আমাদের সেকশনগুলোর টীম-স্পিরিট (team spirit) গড়ে উঠবে না, এবং
যুদ্ধক্ষেত্রে এর ফলাফল ভয়াবহ হবে। আমাদের আজিমপুর দলের সবচেয়ে বড় শক্তি আমাদের
পারস্পরিক বন্ধুত্ব। ঠিক একই ভাবে আমাদের নতুন সদস্যদের সাথে আমাদের সেতু বন্ধন
গড়তে হবে। এই কথাটা আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে, আমার আজিমপুরের বন্ধুদের বুঝতে হবে।
চিন্তা করতে করতে
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন পাঁচটা
বাজে।
রাতের খাবারের পর
আবার ক্যাপ্টেন রানার তাঁবুতে গেলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব তখন চার সুবেদারের সাথে কথা
বলছেন। ক্যাপ্টেনের তাঁবুর দুটি চেয়ারের মধ্যে একটিতে ক্যাপ্টেন ও অন্যটিতে
সুবেদার-মেজর বশীর, আর বাকী তিনজন দাঁড়িয়ে
আছে। তারা কথা বলছে দেখে আমি
তাঁবুর ভিতরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে সুবেদার সাহেবেরা বেরিয়ে
গেলে আমি তাঁবুতে ঢুকলাম।
“এসো সোহেল বস,” খালি চেয়ার দেখিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন। আমি সালাম দিয়ে চেয়ারে
বসলাম।
“বলো, কী খবর তোমার? বাজার কেমন দেখলে?” ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করলেন। এই রকম কিছু মামুলি কথা শেষ হলে
আমি যা চিন্তা করছিলাম সেগুলো ক্যাপ্টেন কে বিস্তারিত জানালাম।
আমার সব কথা
শুনার পরে ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন,
মনে হয় চিন্তা
করলেন কী বলবেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, “হাঁ, অস্ত্রের ব্যাপারটা আমিও ভেবেছি এবং তোমার সাথে একমত। এই
কোম্পানির সব সুবেদার, কিছু হাবিলদার, ও যারা বিশেষ কাজ করে,
যেমন বিস্ফোরক, মর্টার, লাইট-মেশিনগান চালকের
সহযোগী, ইত্যাদি, শুধু তাদেরকে সাব-মেশিনগান দেয়া হয়েছে। বাকী সবার কাছেই
রাইফেল।“
একটু থেমে
ক্যাপ্টেন আবার বলতে থাকলেন, “তোমাদের থাকার ব্যাপারে, আমি নিজেই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। ভালই হলো তুমি কথাটা
বলাতে। হাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, তোমাদের আলাদা থাকা ঠিক হচ্ছে না। আমি জানি যে তোমরা ১৪-জন
ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এই যুদ্ধের সময় তোমাদের শুধু বন্ধুদের কথা ভাবলে হবে না, তোমরা সবাই যেহেতু শিক্ষিত ও সাহসী সেজন্য তোমাদেরকে বন্ধু
ছাড়াও অন্যদেরকে নেতৃত্ব দিতে হবে।“
“ও, আচ্ছা, তোমাদের বিস্ফোরকের
ট্রেনিং-এর ব্যাপারে আমি মাসুমকে নির্দেশ দিয়েছি, সে তোমাদেরকে
ট্রেনিং দেবে। তোমাদের সবার তো বিস্ফোরকে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই, ৪-৫ জন ঠিক করো যারা এই ট্রেনিং নিবে। কে কে ট্রেনিং নিবে কালকে
আমাকে জানাবে।“ ক্যাপ্টেন তার বক্তব্য
শেষ করলেন। আমি ক্যাপ্টেনের কাছে বিদায় নিয়ে আমার তাঁবুতে ফিরে এলাম এবং
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে
নাস্তার পর আবার আমরা ১৪-জন গোল হয়ে বসলাম। গত রাতে ক্যাপ্টেনের সাথে আলোচনা
বিস্তারিত সকলকে জানালাম। সব সেকশন কমান্ডারদের নিজ নিজ সেকশনে কার কী অস্ত্র থাকা
উচিৎ তার একটা তালিকা করতে বললাম।
আমাদের ৪০-জনের
জন্য মোট তিনটি তাঁবু। একটি তাঁবু বেশ বড়, এখানে ২০-জন থাকতে পারবে, বাকী দুটি তাঁবুতে দশ জন করে থাকলেই সমস্যার সমাধান।
প্রতিটি সেকশন
তাদের সব সদস্যসহ একই তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলাম এবং কে কোন
তাঁবুতে থাকবে সেটা ঠিক করতে বললাম।
আমাদের মিটিং শেষ
হবার সাথে সাথে ক্যাপ্টেনের ব্যাটম্যান এসে জানাল সাহেব সালাম দিয়েছেন। আমি
ব্যাটম্যানের সাথে ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে গেলাম। ক্যাপ্টেন তাঁবুতে একা, চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের সাথে একটি ম্যাপ দেখছেন, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট,
আমাকে দেখে হাতের
ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পরে ম্যাপ দেখা শেষ হলে আমার দিকে ফিরলেন।
টেবিলে একটি সিগারেটের প্যাকেট ও দিয়াশলাই ছিল। সিগারেটের প্যাকেট খুলে আমার দিকে
বাড়িয়ে দিলেন। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কয়েক টান দেবার পর ক্যাপ্টেন নীরবতা
ভাঙলেন।
“আমাকে সেক্টর-হেড-কোয়াটার
একটি মিশনের দায়িত্ব দিয়েছে। মিশনটা কী সেটা তোমাকে পরে বলব। কিন্তু মিশনে যাবার
আগে আমাদের যায়গাটা রেকি (reconnocense) করতে হবে। আমি চাই তুমি
আমার সাথে যাবে। রেকি দলে দশ জন থাকবে। তুমি চাইলে তোমার দল থেকে কয়েকজনকে নিতে পার। তুমি
একটু চিন্তা করে কালকে আমাকে জানাবে। ও, হাঁ, তোমাদের কে কে বিস্ফোরকের ট্রেনিং নিবে ঠিক করেছ?”
“রেকিতে কে কে যাবে সেটা
কালকে আমি আপনাকে জানাব। বিস্ফোরকের ট্রেনিং এর জন্য চার জনকে ঠিক করেছি; সেলিম, সারোয়ার, সবুজ, ও আমি।“
“তুমি তো প্লাটুন
কম্যান্ডার, তোমার বিস্ফোরক ট্রেনিঙের
কী দরকার?” ক্যাপ্টেন ভুরু কুঁচকে
প্রশ্ন করলেন। “আমি সিভিল
ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। যে কোন দালান বা ব্রিজ সম্পর্কে আমি এখানে সবার
থেকে ভাল বুঝি। আমি জানি এ সকল স্থাপনার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা কোথায় যেখানে
বিস্ফোরক লাগালে সবচেয়ে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। সে জন্যই প্লাটুন লিডার হওয়া
স্বত্বেও আমার বিস্ফোরক সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা উচিৎ যেন
পরিকল্পনার সময় কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগান দরকার সে বিষয়ে আমি সুপারিশ করতে পারি।
তাছাড়া, সারোয়ার খুবই বুদ্ধিমান ও ধীরস্থির স্বভাবের। বিস্ফোরকের
জন্য আদর্শ। সবুজ হচ্ছে আমার দলের গুপ্তচর,
অনেক সময় হয়ত
তাকে একাই বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হতে পারে। শেষ হচ্ছে সেলিম। সেলিমকে খুবই সাহসী
বলে নিতে চাই।“
আমার কথা শেষ হলে
ক্যাপ্টেন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর তার
ঠোটের কোনে এক হাসি ফুটে উঠল। উত্তরে তিনি বললেন, “বুঝেছি, ঠিক আছে। আমরা পরশুদিন রেকিতে যাব, কালকে অবশ্যই তুমি তোমাদের দলের কে কে যাবে আমাকে জানাবে।“
আমি তাঁবুতে
ফিরতে ফিরতেই চিন্তা শুরু করলাম যে কাকে কাকে রেকি দলে নেয়া যায়। প্রায় সাথে সাথেই
ঠিক করে ফেললাম। দশ জনের মধ্যে আমরা পাঁচ জন থাকব। সেলিম, কবীর, কবীরের সহকারী ইদ্রিস, সবুজ ও আমি।
আমি তাঁবুতে ফিরে
সবাইকে ক্যাপ্টেনের সাথে আলোচনা সংক্ষেপে জানালাম। রেকি দলে কারা যাবে আমার মতামত
বললাম, কেউ আপত্তি করল না।
আমি আমার মধ্যে
একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। যতই দিন যাচ্ছে দলের সদস্যাদের সাথে আমার
অনুরোধগুলো ক্রমেই নির্দেশে পরিণত হচ্ছে। এখন আমি যা বলছি প্রায় সবাই বিনা দ্বিধায়
সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্য সেলিম নিজেও। আমার মনে হয় কোনো দলের নেতা
হতে গেলে প্রথমে নেতৃত্বের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। একবার নিজেকে যোগ্যতার বলে
প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে পরবর্তীতে কেউ সিদ্ধান্ত মানতে আপত্তি করে না।
পরের দিন সকালে
নাস্তার পরে আমি ক্যাপ্টেনকে আমাদের রেকি দলে যারা থাকবে তা জানালাম। ক্যাপ্টেন
বললেন, “ঠিক আছে। আমরা কালকে একদম ভোরে, সূর্য উঠার আগে বের হব,
তোমরা ০৪:৩০
নাগাদ রেডি থাকবা। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের জন্য চিড়া, গুড়, ও কলা থাকবে, সেদিন নাস্তা ও দুপুরের খাওয়া সেটা দিয়ে সারতে হবে। আমাদের
এই মিশন শেষ হলে তোমাদের বিস্ফোরকের ট্রেনিং শুরু হবে।“
আমি সাথে কী অস্ত্র
নিব তা নিয়ে দোটানায় পড়লাম। আমার কাছে এখন একটা এক-৪৭ ও একটা স্টারলিং। স্টারলিং
আমি ব্যবহার করেছি এবং এই অস্ত্রের সাথে আমি এখন ভালই পরিচিত। অন্যদিকে, এক-৪৭, স্টারলিং থেকে অনেক উন্নত
অস্ত্র হলেও আমি এখনও এই অস্ত্র ব্যবহার করিনি ফলে এই অস্ত্রের সম্পর্কে আমি বিশেষ
কিছুই জানিনা। কাজেই এই অস্ত্রে সম্পর্কে কিছু না জেনে এটা কী যুদ্ধে নেয়া উচিৎ? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে স্টারলিং নেয়াই
বুদ্ধিমানের কাজ হবে। একে-৪৭ যুদ্ধে ব্যবহার করার আগে এই অস্ত্রে ব্যবহারের
কলাকৌশল জানা সহ বেশ কিছু রাউন্ড গুলি ছুড়ে অস্ত্র সম্পর্কে ভাল ধারণার পরই যুদ্ধে
এই অস্ত্রে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
যেহেতু রেকি করতে
যাচ্ছি, আমার .৩২ রিভলভার সাথে
নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমাদের এই .৩২ রিভলভার ব্যবহার করার একমাত্র সমস্যা
এই অস্ত্রের গুলির সংখ্যা খুবই সীমিত। ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করতে হবে পিস্তল ও
রিভলভারের কিছু গুলি যোগাড় করে দিতে। আমাদের ঢাকায় দখল করা যতগুলি পিস্তল ও
রিভলভার আছে তার মধ্যে একমাত্র .৩২ রিভলভার ব্যক্তিগত
নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার যোগ্য। আমাদের অন্য .২২ বা .২৫ রিভলভার বা পিস্তলগুলো
প্রায় খেলনার মতো।
আমি তাঁবুতে ফিরে
আমাদের রেকি দলের সদস্যদের ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত জানালাম।
আগামীকাল রেকিতে
যাব, তাই সবাইকে নিজ নিজ
অস্ত্র ভালভাবে পরিষ্কার করে রাখতে বললাম। নিজেও আমার অস্ত্রগুলো পরিষ্কার করতে
শুরু করলাম। এভাবে দেখতে দেখতে দুপুরের খাবার সময় হয়ে এলো। খাবার পর তাঁবুতে ফিরে
যারা আমার সাথে রেকিতে যাবে তাদের ঘুমাতে বললাম। রাত সাড়ে চারটায় ক্যাম্প থেকে
যাত্রা শুরু করতে হলে ঘুম থেকে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ উঠতে হবে। তাই যতটুকু সম্ভব এখনি ঘুমিয়ে
নেয়া উচিৎ। কিছুক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতে খাবার পর
আবার ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ডাক পড়ল। ভোর রাতে আমরা যারা রেকিতে যাব সবাই তাঁবুর
সামনে জড় হলাম। আজকে একটি হ্যাজাক-লাইটের উজ্জ্বল আলো ক্যাপ্টেনের তাঁবুর সামনের
যায়গাটা দিনের মতো পরিস্ফুট হয়ে আছে। মাটিতে একটা ম্যাপ বিছানো। হ্যাজাকের উজ্জ্বল
আলোতে আমরা সবাই ম্যাপের খুঁটিনাটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন হাঁটু
গেড়ে মাটিতে বসে আছেন, হাতে বাসের চিকন কঞ্চি। আমরা অন্য
সবাই ম্যাপকে ঘিরে বসে আছি।
ক্যাপ্টেন একবার
সবাইকে দেখে তার বাঁশের কঞ্চি ম্যাপে একটি যায়গা নির্দেশ করে বলতে শুরু করলেন।
“এইটা ঢাকা-সিলেট রেল লাইন। প্রত্যেক দিন আখাউড়া
থেকে একটি ট্রেন এই রেললাইনের আশেপাশে যতগুলো পাকিস্তানি অবস্থান আছে তাদের জন্য
গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, ও সৈন্য আনা-নেয়া করে।
আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই ট্রেনের ইঞ্জিন ধ্বংস করতে। এই ইঞ্জিন বাষ্প-চালিত
(steam engine), সাধারণত এই ট্রেনে চারটি
বগি থাকে। এই রেললাইন অনেক জায়গায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে, আবার কোথাও কোথাও সীমান্ত থেকে বেশ দূরে। আমাদের রেকির
উদ্দেশ্য একটি উপযুক্ত যায়গা নির্বাচন করা যেখানে কাজটি সহজে ও নিরাপদে করা
যাবে।
আখাউড়ার পরে
অনেকগুলো স্টেশন আছে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাঁতে মনে হয় হরসপুর ও মনতলা
স্টেশনের মধ্যবর্তী যায়গা এই অপারেশনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কাজেই আমাদের রেকি
কার্যক্রম এই এলাকাতেই হবে।
আমরা গাড়িতে
ভারতের তুলশীপুর সীমান্ত পর্যন্ত যেতে পারব। তুলশীপুর সীমান্ত থেকে রেললাইনের
সোজাসুজি দূরত্ব আড়াই মাইলের মতো। কিন্তু একটু ঘুরে যেতে হবে বলে সাড়ে-তিন মাইল
ধরাই ভাল হবে। যুদ্ধ শুরুর আগে এখানে অনেক বাড়ি-ঘর ছিল। বাড়ি এখনও আছে কিন্তু
লোকজন সব ভয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছে। ফলে এলাকাটা এখন জনশূন্য। যদি কোন লোক দেখা যায় তাহলে ধরে
নিতে হবে সে পাকিস্তানিদের সহযোগী,”
ক্যাপ্টেন
একনাগাড়ে কথা বলার পর একটু থামলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, “সোহেল, কোনো প্রশ্ন?” আমি না বললে আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের পাঁচ জনের কাছে কী অস্ত্র থাকবে?” আমি উত্তর দিলাম, “আমাদের কাছে একটি ভারতীয় LMG ও চারটি স্টারলিং সাব-মেশিনগান থাকবে।“
এবার ক্যাপ্টেন
নায়েব-সুবেদার হান্নানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “হান্নান সাহেব, আমাদের কী অস্ত্র থাকবে ও কে কে যাবে?” হান্নান উত্তর বললেন,
“স্যার, আপনি, হাবিলদার মাসুম, কামরুল, গফুর ও আমি। স্যার, আপনি পাঁচজন বললেও আমি মাসুমকে যোগ করেছি কেননা মনে হয়েছে
বিস্ফোরকের প্রয়োজন হবেই, তাই মাসুমকে সাথে নেয়া। অস্ত্র
থাকবে দুটি এক-৪৭, একটি চাইনিজ LMG, আর দুইটি স্টারলিং সাব-মেশিনগান।“ ক্যাপ্টেন সম্মতি দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে।“ আমার দিকে ফেরে আবার বললেন, “সোহেল, তোমার দলের সবার সাথে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দেও।“ আমি আমাদের দলের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
মিটিং শেষ করার
আগে ক্যাপ্টেন আবার জানতে চাইলেন, “কারো কোনো প্রশ্ন আছে?” কোন প্রশ্ন নেই দেখে ক্যাপ্টেন বললেন, “ঠিক সাড়ে-চারটার সময় আমরা রওয়ানা হব। সবাই তাঁবুর সামনে
রেড়ি থাকবে। আজকের মিটিং এখানে শেষ এখন সবাই তাঁবুতে যেয়ে বিশ্রাম কর।“
আমরা তাঁবুতে
ফিরে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
বেলা পাঁচটায় ঘুম
থেকে উঠলাম। দেখি অন্য সবাই ইতোমধ্যে ঘুম থেকে উঠেছে। এখন আমাদের প্রত্যেক তাঁবুতে
দুটি মাটির কলসি আছে, খাবার পানি রাখার জন্য।
এক মগ পানি নিয়ে কিছুটা খেলাম আর বাকীটা দিয়ে মুখ ধুয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমি
সাধারণত দিনে ঘুমাই না। কিন্তু আজকে সাধারণ দিন না। ভোর রাতে মিশনে বের হব।
আমাদের ১৪-জনের
তিনটি তাঁবুতে ছড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত হলেও সেটা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। আমার
ডানদিকে সেলিমের বিছানা। সেলিম আমার মতো বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে
সিগারেট টানছে, মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায়
মগ্ন।
আমার বামদিকের
বিছানা সারোয়ারের। সারোয়ার বিছানায় বসে যত্ন করে তার SLR রাইফেল ও .৩২ রিভলভার পরিষ্কার করছে। সিগারেট শেষ হলে আমি
তাঁবুর বাইরে এলাম। ক্যাম্পে আমাদের সকলকেই বেশ কিছু কাজ করতে হয়। এটাকে বলে ফেটিক
ডিউটি। আমি প্লাটুন কম্যান্ডার তাই আমার ফেটিক ডিউটি করার কথা না, কিন্তু তা স্বত্বেও আমি দলের অন্যদের মতো ফেটিক করি।
ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে অনেক কাজ থাকে, যেমন ক্যাম্প পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন রাখা, রান্নার জন্য জঙ্গল থেকে
কাঠ কেটে আনা, পরিখার রক্ষণাবেক্ষণ করা, নতুন খাবার বা গোলা বারুদ এলে সেগুলো যথাস্থানে রাখা, যেই মাটির রাস্তা দিয়ে আমাদের জিপ চলাচল করে সেটার দেখভাল ও
প্রয়োজনে মেরামত করা, বৃষ্টির পানি নিষ্কাসনের
জনা ড্রেন তৈরি করা অথবা মেরামত করা, ইত্যাদি অসংখ্য কাজ থাকে
যেগুলো ফেটিকের মাধ্যমে করা হয়। আজকে অবশ্য আমাদের ফেটিক নেই। কোন দিন কে ফেটিক
করবে সেটা সুবেদার-মেজর বশীর নির্ধারণ করেন।
ঘড়িতে এখন প্রায়
পৌনে-ছয়টা। এখন সূর্য ডুবে প্রায় সাড়ে-ছটার সময়। এখন স্ট্যান্ড-টু হয় ছয়টা বিশ
মিনিটে। স্ট্যান্ড-টু শেষ হলে রাতের খাবার। কাজেই হাতে কিছু সময় আছে। আবার তাঁবুতে
ঢুকে বিছানায় বসে আরেকটা সিগারেট ধরালাম।
জানি না কেন, হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে হল। আমার জন্ম ঢাকায় হলেও আমার
ছোটবেলা কেটেছে পশ্চিম-পাকিস্তানে। আমার যখন ছয় মাস, আব্বা
পশ্চিম-পাকিস্তানের লাহোরে বদলি হন। আমার স্কুল জীবনের শুরু লাহোরে। ষষ্ঠ শ্রেণী
পর্যন্ত লাহোরে। তারপর আব্বা রাওয়ালপিন্ডিতে বদলি হলে আমরা সবাই রাওয়ালপিন্ডিতে
স্থানান্তরিত হই। সপ্তম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডিতে।
আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে, ফলাফল বের হবার আগেই
আব্বা আবার বদলি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
ফলে, আমি উর্দু, পাঞ্জাবি, ও পশতু অনর্গল বলতে পারি। আমাদের বাসার নিয়ম ছিল বাসায় নিজেদের মধ্যে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। আম্মা ও আব্বা দুজনেই আমার
সাথে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। আমার আম্মাও উচ্চ শিক্ষিত, তিনি কলেজে রসায়ন পড়ান।
আমার আব্বা একটু
ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি কখনো তার মতামত আমার উপরে
চাপিয়ে দেননি। সবসময় চেষ্টা করেছেন আমি নিজে যেন সিদ্ধান্ত নিতে শিখি। তিনি
সাধারণত কিছু বিকল্প দেখিয়ে আমাকে একটি বেছে নিতে বলতেন। কোনো সময় বলতেন না, “তোমাকে এটাই করতে হবে।“
আমার আম্মা অবশ্য
মাঝে মাঝে তার নিজস্ব মতামত আমার উপরে চাপাতে চাইতেন কিন্তু খুব সুবিধা করতে
পারতেন না। এ নিয়ে আম্মা মনে হয় আব্বার উপরে একটু অসন্তুষ্ট ছিলেন, “এভাবে কেউ ছেলেকে মানুষ করে? এতটুকু ছেলে নিজে
কী বুঝে?” আম্মার এই অভিযোগ শুনে
আব্বা কিছু বলতেন না, একটু মুচকি হাসতেন মাত্র।
আব্বা সবসময়
চাইতেন আমি যেন স্বাবলম্বী হতে শিখি। নিজের কাজ নিজে করি, কারো উপরে নির্ভর না করে। তার অবশ্য কিছু পথনির্দেশক নীতি
ছিল যেটা তিনি ছোটবেলা থেকেই আমার মাথায় গেঁথে দিয়েছিলেন, যেমন, মিথ্যা বলবে না; ছোট, বড়, ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে
সবাইকে সম্মান করবে; সব সময় তোমার দায়িত্ব সঠিক
ভাবে পালন করবে; অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবে না
এবং প্রতিবাদ করবে, মানুষকে সাহায্য করবে; অন্যের ব্যথা বুঝতে চেষ্টা করবে, রাগ করবে না, মনে রাখবে রাগ করা মানেই
হেরে যাওয়া; কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে
চিন্তা করবে, তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা
করবে, কিন্তু মনে রেখ যে কোনো সিদ্ধান্তের
জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য তুমি কখনই পাবে না,
এই অপর্যাপ্ত
তথ্য দিয়েই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আবেগের বসে সিদ্ধান্ত
নিবে না; একটি নিদিষ্ট সময়ের পরে
নেয়া সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য থাকে না; এবং পরিশেষে, তোমার কাছে যেটা মনে হয় করা উচিৎ, করবে, ভয় পাবে না। আব্বার এই নির্দেশনাগুলো আমার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে গেছে যে
কোনো কাজ করতে গেলে এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেই।
আমার এই কথাগুলো
বলা দরকার ছিন কেননা অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে যে কোন পিতা তার একমাত্র সন্তানকে
নির্দ্বিধায় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমার আব্বা পারেন এবং এটাই তিনি আমাকে
শিক্ষা দিয়েছেন, শুধু মুখে বললে হয় না, কাজে দেখাতে হয়।
স্ট্যান্ড-টু’র ডাক শুনে আমার চিন্তার ছেদ পড়ল। আমরা সবাই অস্ত্র হাতে
তাঁবু থেকে বের হলাম।
রাতের খাবার শেষ
হলে আবার ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে সবার ডাক পড়ল।
গতানুগতিক শুভেচ্ছা
বিনিময় শেষে ক্যাপ্টেন বলতে শুরু করলেন, “আমি শুধু কয়েকটি কথা
স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আমাদের রেকি মিশনে কোনো গোলাগুলি করতে চাই না। গোলাগুলি
হলে শত্রু টের পাবে যে আমরা এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করছি। ফলে তারা সতর্ক হয়ে যাবে এবং
এই এলাকায় নজরদারি বাড়াবে। কথাটা যেন সবার মনে থাকে। শুধু আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র
ব্যবহার করা যাবে। কেউ খাকী পোশাক পরবে না। সাধারণ কাপড় পরবে, লুঙ্গি পরলে ভাল হয়,
যাদের নেই তাদের
কথা আলাদা।“ সুবেদার মেজর বশীরকে
উদ্দেশ্যে করে বললেন, “বশীর সাহেব যাদের লুঙ্গি
নেই তাদেরকে লুঙ্গি দেবার ব্যবস্থা করবেন।“
আমাদের ১৪-জনের
মধ্যে প্রায় অর্ধেকের লুঙ্গি ছিল না। তাছাড়া লুঙ্গি কেমন করে সুষ্ঠু ভাবে পরে তাও
জানতাম না। অবশ্য যখন বন্ধুদের সাথে পুকুরে,
লেকে, বা নদীতে সাঁতার কাটতে যেতাম তখন সাঁতারের সময় লুঙ্গি
পরতাম। লুঙ্গির ভিতরে বাতাস ভরে ভেসে থাকা বেশ আনন্দদায়ক খেলা ছিল।
যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে আমাদের সংক্ষিপ্ত মিটিং শেষ হলে আবার তাঁবুতে
ফিরে এলাম। ঘড়িতে এখন সাড়ে-সাতটা। আমাদের তাঁবুর ভিতরে টিমটিম করে এক লণ্ঠন ঝুলছে, সেই আলোতে তাঁবুর সবাইকেই মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন
ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকজন জেগে আছে। কেউ সিগারেট খাচ্ছে, বিভিন্ন চিন্তায় মগ্ন। কথাবার্তা বিশেষ হলো না, আমিও শুয়ে পড়লাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙ্গল ঠিক
চারটার সময়। আমাদের দলের অন্য সবাই উঠে গেছে। আমি বিছানা থেকে উঠে কলশি থেকে পানি
নিয়ে মুখ ধুয়ে কাপড় পরলাম। আজকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা প্যান্ট ও শার্ট, পায়ে ক্যানভাসের বুট জুতা, বেল্টের সাথে
কোমরের দুই পাশে গুলির ঝোলা, পিঠে আরেকটা ব্যাগে কিছু
খুচরা গুলি, দুটি ব্যান্ডেজ, ও লাইট-মেশিনগানের দুটি ম্যাগাজিন। আজকে শার্ট প্যান্টের
ভিতরে গুঁজলাম না। রিভলভারটা শার্টের নীচে বেল্টে গুজে রাখলাম। তাছাড়া কিছু খাবার
নিতে হবে। সম্ভবত সেটা একটু পরে আমরা একসাথে হলে দেয়া হবে।
সাড়ে-চারটা বাজার
পাঁচ মিনিট আগেই আমরা পাঁচ জন ক্যাপ্টেনের তাঁবুর সামনে লাইন করে দাঁড়ালাম। দলের
অন্যরা ইতোমধ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা সবাই দাঁড়ালে সুবেদার-মেজর বশীর আমাদের
সবাইকে একটা কাগজের ঠোঙা দিলেন, ভিতরে কিছু চিড়া, গুড়, এ একটা সাগর কলা—এই হলো আমাদের সকালের ও দুপরের খাবার।
ক্যাপ্টেন রানা
তাঁবু থেকে লুঙ্গি পরে বের হয়ে আমাদের সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। আমাদের
মধ্যে সবুজ, কবীর, ও ইদ্রিস লুঙ্গি পরা। আমার আর সেলিমের লুঙ্গি নেই।
ক্যাপ্টেন আমাকে আর সেলিমের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু ঝাঁকালেন, মনে হয় একটু অসন্তুষ্ট হলেন, কিন্তু কিছু
বললেন না। আমাদের দলের বাকী সকলে ক্যাপ্টেন নির্দেশ মতো লুঙ্গি পরা।
ক্যাপ্টেন আজকে
কোনো ভাষণ দিলেন না। হাত নেড়ে সবাইকে চলার নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই এক লাইনে
হাটতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ
হেটে ধানক্ষেত পার হবার পর দেখলাম বড়
রাস্তায় দুটি জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে,
একটি আমাদের
কোম্পানির জিপ আরেকটি মনে হয় সেক্টার-হেড-কোয়াটার থেকে সংগ্রহ করা। প্রথম জিপে
ক্যাপ্টেন রানা তার দলবল সহ উঠলেও একজন আমাদের জিপে যোগ দিল। সেলিম ও আমি জিপের সামনে
ড্রাইভারের পাশে বসলাম, বাকি চারজন জিপের পেছনে
বসল। আমাদের সবার ঘাড়ের ব্যাগগুলো জিপের পেছনে স্তূপ করে রাখলাম।
জিপ দুটি চলতে
শুরু করল। আজকে পাঁচটা বিশ মিনিটে সূর্যোদয়,
এখন পাঁচটা বাজে।
চারিদিকে ইতোমধ্যে সকাল হবার পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে, আমাদের জিপগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে দক্ষিণ থেকে পূর্ব দিকে
যাচ্ছে। পূর্ব দিক ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং কিছুক্ষণ পরেই ড্রাইভার হেডলাইট নিভিয়ে
দিল। এই রাস্তায় আমাদের প্রথম যাত্রা;
এই রাস্তায় আগে
কখনো আসিনি। ড্রাইভারের কাছ থকে জানলাম এই রাস্তা দিয়ে আগরতলা যাওয়া যায়।
মাঝে মাঝে
রাস্তার দুপাশে এক গুচ্ছ বাড়িঘর তারপরে আবার জঙ্গল মতো অথবা কখনো ধানক্ষেত। জনবসতি
খুবই কম। কিছুক্ষণ পরে হাতের বামদিকে একটা বেশ বড় মাটির তৈরি একতালা দালান দেখতে
পেলাম, দালানের সামনে মাস্টে
দুটি পতাকা ঝুলছে, একটি ভারতীয় জাতীয় পতাকা
অন্যটি BSF-এর পতাকা।বাড়ির সামনে
একটা বড় ফটক। ফটকের সামনে খাকী পোশাক পরিহিত দুজন জোয়ান ৩০৩ রাইফেল হাতে পাহারা
দিচ্ছে। ড্রাইভার জানাল এটা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের বড় ফাঁড়ি বা বর্ডার
অভজারভেশন পোস্ট (BOP)।
ফাঁড়ির
পাহারাদাররা আমাদেরকে নির্লিপ্তভাবে দেখল কিন্তু কিছু বলল না। বুঝতে পারলাম তারা
গাড়িগুলো চিনে।
যাত্রা শুরুর
প্রায় এক ঘণ্টার মাথায় আমাদের জিপ দুটো রাস্তার পাশে থামলে আমরা সবাই জিপ থেকে
নামলাম। আমাদের ডান দিকে সরু একটা মাটির রাস্তা, একজন লোক আমাদের
জন্য রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিল। আমারা নামার পর সে ক্যাপ্টেনকে রাস্তার একপাশে
নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন আমাদের জানালেন যে লোকটি আমাদের
গাইড়, সে’ই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। লোকটার পিছনে আমরা সবাই এক
লাইনে হাটতে শুরু করলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম সবুজ গাইড়ের সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে, দুজনেই সিগারেট খাচ্ছে। কিছুক্ষণ হাটার পর গাইড থামল এবং
জানল যে এটাই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত; এটা যে সীমান্ত বুঝার
কোনো উপায় নেই। গাইড় বলল যে আমরা এখন বাংলাদেশে প্রবেশ করব এবং এখান থেকে সাবধানতা
নিতে হবে। ক্যাপ্টেন রানা সবার সিগারেট নিভিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলেন এবং জানালেন
এখন থেকে আর সিগারেট খাওয়া যাবে না।
আমরা বাংলাদেশে
প্রবেশ করলাম। কেমন যেন একটা শিহরণ বিদ্যুতের মত শরীরে সঞ্চারিত হলো, এটাই আমার দেশ, এই দেশের জন্যই আমরা
যুদ্ধ করছি, প্রাণ দিচ্ছি।
এই এলাকা এখন
জনশূন্য, সব মানুষ পাকিস্তানি সেনা
ও রাজাকারদের ভয়ে এলাকা ছাড়া। বেশীর ভাগই এখন ভারতের শরণার্থী। বেশ কিছুদিন আগাছা
পরিষ্কার না করায় চারিদিকে জঙ্গল মতো হয়ে আছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো ছিটানো কিছু বাড়ি ঘর
দেখা যাচ্ছে।
গাইড়ের কাছ থেকে
জানতে পারলাম এইটা তুলশীপুর সীমান্ত, রেললাইন সীমান্ত থেকে
প্রায় তিন মাইল পশ্চিমে। আমাদের একটু
সাবধানে যেতে হবে কারণ মাঝে মাঝে রাজাকাররা গৃহস্থের বাড়িঘরে ফেলে যাওয়া মালামাল
অথবা বাসার পরিত্যক্ত গাছগাছালি থেকে ফলমূল ও শাকসবজি লুট করতে আসে। এখন সম্পূর্ণ
এলাকাটা জঙ্গলে ভরা, ঘাসগুলো অনেক বড় বড় হয়ে
আছে। গাইড জানাল যে ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তের অনেক স্থানে মাইল পুতে
রেখেছে কিন্তু এই এলাকায় এখনও লাগায়নি। শুনে আমরা সবাই একটু আশ্বস্ত হলাম, মাইনের আঘাতে পা হারানর খায়েশ আমাদের কারো নেই।
এভাবে ঘণ্টা
দেড়েক হাটার পর আমরা কতগুলো কুটিরের কাছে পৌঁছলাম। গাইড় আমাদেরকে এখানে থামতে বলল।
“এই কুটির-গুলর পরে একটু খালি জায়গা, তার পরেই রেললাইন।
রেললাইন দেখতে হবে এই কুটিরগুলোর আড়াল থেকে দেখতে হবে। এই দিনের বেলা এই দিকে
পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার উভয়ের যাতায়াত আছে,”
গাইড বলল।
ক্যাপ্টেন রানা
সবাইকে এখানে আড়াল নিয়ে বসতে বললেন। আমারা সবাই কুটিরের আড়াল থেকে রেললাইন দেখতে
লাগলাম। এখন চারিদিকে কোনো লোকজন অথবা গোরু ছাগল এমনকি কোনো কুকুরও চোখে পড়ল না।
চারিদিক নিস্তব্ধ, মাঝে মাখে পাখিরা
কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে যাছে। এইটা ফুরফুরে বাতাস আমাদেরকে মাঝে মাঝে তার
মোলায়েম পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। এই ঘরগুলোর চারিদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা কাজেই বেশ
ঠাণ্ডা।
আমরা যেখানে
লুকিয়ে আছি সেখান থেকে রেললাইনের দূরত্ব পায় ১০০-গজ। আমি আর ক্যাপ্টেন রানা
পাশাপাশি মাটিতে শুয়ে রেললাইন দেখছি। ক্যাপ্টেন রানার হাতে একটা বাইনোকুলার। তিনি
চারিদিক ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছেন। তার দেখা শেষ হলে বাইনোকুলার আমাকে দিলেন। আমিও
তার মতো চারিদিক দেখলাম, কিন্তু বিশেষ কিছু দেখতে
পেলাম না। রেললাইন আধা মাইলের মতো সোজা যাবার পর ডানদিকে মোড় নিয়েছে এবং কিছুদূর
পর গাছগাছালির আড়ালে ঢাকা পড়েছে।
“এখান থেকে রেললাইনের
দূরত্ব কত হবে?” ক্যাপ্টেন আমার কাছে
জানতে চাইলেন।“ “১০০ থেকে ১১০ গজ,” আমি উত্তর দিলাম। ক্যাপ্টেন মাথা নাড়ালেন। বুঝতে পারলাম
তিনি চিন্তা করছেন কেমন করে ও কোথা থেকে আক্রমণ করা যায়। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “চল, যায়গাটা আরেকটু ভাল করে
দেখি। এই জায়গায় ১০-১৫ জনের লোকের বেশী রাখা যাবে না।“
অন্যদেরকে এখানে
থাকতে বলে গাইড় সহ আমরা দুজন গাছকে আড়ালে থেকে সাবধানে আমাদের ডান দিকে
আগালাম। আমাদের একটু ডানে একটা ছোট খালের মতো,
খালটা একটি ছোট
কালভার্ট নীচ দিয়ে রেললাইনের ওপারে গিয়েছে।
“রেললাইনটা যেয়ে দেখতে
পারলে ভাল হতো,” ক্যাপ্টেন আমার দিকে
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আশেপাশে কোন লোক দেখতে পেলাম না। আমি উত্তর দিলাম, “চলেন।“ গাইড়কে অপেক্ষা করতে বলে
আমরা দুজন রেললাইনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রেললাইন ধানক্ষেত
থেকে প্রায় ৬-ফিট উঁচুতে। আমরা সহজেই ধানক্ষেত পেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে রেললাইনে
উঠলাম। রেললাইনের নীচে সহজেই মাইন বা বিস্ফোরক লাগান যায়। তাছাড়া আমরা ফক্সহোল তৈরি করে ধানক্ষেতের পাশে অবস্থান নিতে
পারি। কিন্তু একটা সমস্যা হবে। রেললাইনের উপরে অনেক পাথর। এখানে বিস্ফোরণের ফলে
প্রচুর পাথর বৃষ্টির মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা যদি ফক্সহলেও থাকি, অনেক পাথর ও অন্যান্য জিনিস আমাদের মাথায় পড়বে।
কিছুক্ষণ পরে
রেললাইন দেখা শেষ হলে আমরা যখন ধানক্ষেতে নামব,
তখন দূরে
রেললাইনের উপরে কিছু লোককে আমাদের দিকে আসতে দেখলাম। এখন যদি আমারা ধানক্ষেত দিয়ে
ফিরে যেতে চাই তাহলে এই লোকগুলো আমাদেরকে দেখে ফেলবে। কী করা যায়। আমি ক্যাপ্টেনকে
বললাম, “চলেন কালভার্টের নীচে
লুকাই।“ আমরা হামাগুড়ি দিয়ে নেমে
আবার হামাগুড়ি দিয়ে কালভার্টের দিকে গেলাম। কালভার্ট আমাদের থেকে প্রায় ২০ গজ দূরে, লোকগুলো কাছাকাছি আসার আগেই আমরা কালভার্টের নীচে আশ্রয়
নিলাম। কিছুক্ষণ পরে ছয়-সাত জন লোকের পায়ের ও কথাবার্তার আওয়াজ পেলাম। কথা শুনে
বুঝলাম লোকগুলো বাঙ্গালী অর্থাৎ এরা রাজাকার। এরা কালভার্টের উপরে থামল। আমরা
দেখতে না পেলেও ও বুঝতে পারছিলাম যে তারা দেখছে কালভার্টে সন্দেহজনক কিছু আছে কি
না। আমরা কালভার্টের নীচে আমাদের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত। এই রাজাকারকে আমরা ভয়
পাচ্ছি না, আমাদের ভয় যদি আমাদের
দেখে ফেলে তাহলে আমাদের রেকি মিশন বৃথা হবে কেননা পাকিস্তানিরা যদি জানতে পারে যে আমরা এখানে রেকি করতে এসেছিলাম তাহলে এখানে তাদের নজরদারি অনেক বৃদ্ধি পাবে।
যাক বেশীক্ষণ
অপেক্ষা করতে হলো না, রাজাকাররা গল্প করতে করতে
চলে গেল। আমরা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কালভার্টের নীচ থেকে বেরিয়ে আমাদের দলের
সাথে যোগ দিলাম।
আমার মনে হচ্ছিল
যে আমার সাথে একটা নোটবই ও পেনসিল আনা উচিৎ ছিল। আমি ভাল স্কেচ করতে পারি, এই সম্পূর্ণ যায়গার একটা স্কেচ থাকলে আমাদের আক্রমণের
পরিকল্পনা আরও ভাল করা যেত। এখন অবশ্য হায় হুতাশ করে লাভ নেই, পরের বার অবশ্যই করব।
কোনো অঘটন ছাড়াই
আমরা নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলাম ঘড়িতে বেলা দুইটা। অবশ্য
একটা সমস্যা হলো, আমাদের জন্য কোন খাবার
ছিল না। কিন্তু আমরা না খেয়ে থাকব সেটা সুবেদার-মেজর বশীর মানলেন না। সাথে সাথে
আমাদের জন্য গরম গরম ভাল, ডাল, ও ডিম ভাজির ব্যবস্থা হলো, যদিও খেতে খেতে
প্রায় তিনটে হয়ে গেল। আমাদের সাথের চিড়া, গুড়, ও কলা কেউ খায়নি। কলাটা রেখে চিড়া আর গুড় ফেরত দিয়ে দিলাম।
একটু ক্লান্ত
লাগলেও এই অবেলায় আর ঘুমলাম না। আমাদের দলের অন্য সদস্যদের সাথে আজকের অভিজ্ঞতা
বর্ণনা করলাম।
আশা করছিলাম
রাতের খাবার পর ক্যাপ্টেন আমাদেরকে ডাকবেন,
কিন্তু সেরকম
কিছু হলো না। আমি সাড়ে সাতটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন